ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার

স্বাধীন বাংলাদেশে এ যাবতকালের সবচাইতে বড় মর্যাদাশীল উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ১২০ কোটি ডলার ঋণ প্রাপ্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু টাকা ছাড় করার আগেই সেতু নির্মাণের দরপত্র মূল্যায়নের পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ঋণ স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংকের মূল কথাই ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাতে বোঝাই যায় দুর্নীতি তখনও হয়নি। অভিযোগ ছিল, কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতুর একটি ছোট অংশের কাজ পাওয়ার জন্য তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রীসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। তদনুযায়ী এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডার আদালতে মামলা করে বিশ্বব্যাংক। প্রায় পাঁচ বছর মামলা চলার পর গত ১০ ফেব্রুয়ারি কানাডার আদালত মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে এই বলে যে, গাল-গল্প ও সম্পূর্ণ গুজবের ওপর নির্ভর করে মামলা করা হয়েছে, অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই, এর সবকিছু কল্পনাপ্রসূত। এর পরিষ্কার অর্থ বিশ্বব্যাংক তখন সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে। বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান ভুল করে এমন একটা অভিযোগ উত্থাপন করেছে সে কথা যুক্তিতে টিকে না। বিশ্বব্যাংক প্রথমে ঋণ স্থগিত করে ২০১১ সালে। তারপর মন্ত্রী, সচিব, প্রকল্প পরিচালকসহ আরও একজন সিনিয়র উপদেষ্টাকে অপসারণ ও গ্রেফতারের জন্য চাপ দেয়। চাপে পড়ে মন্ত্রীকে অপসারণ এবং সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরকার গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। তাতেও তারা সন্তুষ্ট হন না। তাই যে কারণ দেখিয়ে কানাডার আদালত মামলা খারিজ করে দিয়েছে তাতে সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, সম্পূর্ণ মিথ্যা একটা অভিযোগ নিজেরা তৈরি করে বিশ্বব্যাংক সরকারের ওপর এত বড় চাপ সৃষ্টি করল কেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর হয়ত আমরা সরকারের বাইরের মানুষ কোন দিন জানতে পারব না। তবে বিশ্বব্যাংকের ট্র্যাক রেকর্ডের দিকে তাকালে অনেক কিছু অনুমান করা যায়। সম্পূর্ণ আলাদা স্বাধীন সত্তা হলেও বিশ্বব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের কথা সকলে জানেন। বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির খেলায় জড়িয়ে পড়া বিশ্বব্যাংকের জন্য নতুন ঘটনা নয়, এটা ওপেন সিক্রেট। কয়েকদিন আগে একটা পত্রিকার প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক ব্যক্তি এবং মিডিয়ার একাংশ যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সহায়তা নিয়ে বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ঋণ প্রত্যাহারের ব্যাপারে প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১২ সালের মে মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে নতুন চুক্তি সমঝোতা পত্র স্বাক্ষর হয়নি অথবা সম্পর্কের নতুন কোন দিকও উন্মোচিত হয়নি। তাই হিলারি ক্লিনটনের সফরের উদ্দেশ্য কি ছিল এবং এর ফলাফল সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু সৌজন্য সফরে বাংলাদেশে আসবেন তা ঠিক মানান সই মনে হয় না। সফরের সময় স্বনামখ্যাত ও বিশ্ব খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের দুজন নাগরিক একসঙ্গে হিলারির সঙ্গে দেখা করে কি বলেছিলেন তার সামান্য কিছু তখন পত্রিকায় এসেছিল। হিলারি ক্লিনটনের সফরের দেড় দুই মাসের মাথায় বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। তারপর আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা যুক্তরাষ্ট্র বাতিল করে দেয়। তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনার ভূমিকা তো চাক্ষুস সবাই দেখেছেন। পূর্বের ট্র্যাক রেকর্ডকে উদাহরণ ধরা হলে মানতে হয় নিজেদের বা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাংক বহু রকম কূটচাল চালতে পারে, এটা নতুন কিছু নয়। তাই প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বব্যাংকের ট্র্যাক রেকর্ড জানা থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হচ্ছে শুধু এই অভিযোগে নিজ দেশের এত বড় স্ট্র্যাটেজিক জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একশ্রেণীর সুশীল ও মিডিয়ার একাংশ বিশ্বব্যাংকের সুরে সুর মিলিয়ে কোরাস গাইতে শুরু করলেন কেন? তখন তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। বিশ্বব্যাংক বলল, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। আর আমাদের এনারা বললেন, দুর্নীতি হয়েছে, টাকা মেরে দেয়া হয়েছে। অথচ তখনও একটি টাকাও ছাড় করা হয়নি। এই সুশীল ও মিডিয়ার সবাই আবার নিরপেক্ষ। ঋণ বাতিলের প্রাক্কালে, সেই ঝড়ের সময় কে কি বলেছিলেন তার বিস্তারিত একটা বিবরণ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছে। টিআইবি, সুজন, ২০০৭-২০০৮ মেয়াদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং মিডিয়ার যে অংশটি বিশ্বব্যাংকের কোরাসে যোগ দিয়েছিলেন তারা এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কিছু সুশীল ব্যক্তিত্বের লেখা ও বক্তব্য পড়লে বোঝা যাবে তাদের প্রকৃত ভূমিকা তখন কি ছিল। তবে একথাও ঠিক সুশীল মিডিয়ার এ অংশ দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত নন এবং তারা যে এবারই প্রথম বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে নেমেছেন তা নয়। এর আগেও এনাদের একই রকম ভূমিকা দেশের মানুষ দেখেছে। আবার একথাও ঠিক, এ রকম সুশীল শ্রেণীর উপস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের প্রায় সব স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই আছে, যাদেরকে বৈশ্বিক পরাশক্তি নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক ও কর্পোরেটর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করে। বিনিময়ে এসব সুশীলগণ এনজিও খোলে এবং তার মারফত মোটা মাসিক সম্মানী এবং গাড়ি বাড়ি পান। সন্তানদের উন্নত বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান। এনাদের পাসপোর্টে একসঙ্গে বহু দেশের ভিসা লাগানো থাকে, যখন তখন বাইরে যেতে পারেন। যে বৈশ্বিক শক্তির পক্ষে কাজ করেন তাদের কাজ থেকে সভা সেমিনারে যোগদানের জন্য দাওয়াত পান। প্লেনে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ করেন। সুযোগ ও সময় এলে ওই দেশের বা বিশ্ব সংস্থা থেকে যে কোন খেতাব বা পুরস্কার পেয়ে যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং দেশের ভাল-মন্দে নিজের বা তাদের পরিবারের কিছু যায় আসে না। এনারা নিজ দেশের অভ্যন্তরে কিভাবে কাজ করেন তার বাস্তব উদাহরণসহ চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটা বইয়ে। বইটির নাম, কনফেশন অব অ্যান ইকোনমিক হিটম্যান’। বইয়ের লেখক জন পার্কিনস নামের একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, যিনি বিশ্বের বহু দেশে এই শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কাজ করেছেন। বইতে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেক দেশের এই শ্রেণীর সুশীলদের বলা হয় জ্যাকল, যা জন পার্কিনস তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। বইটি পড়লে তাতে উল্লিখিত জ্যাকলদের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচিত সুশীলদের হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ২০০৭-২০০৮ মেয়াদে এই শ্রেণীর সুশীলগণের একটা স্বরূপ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। ওই নিরপেক্ষ সরকারের সময় যা ঘটেছে এবং যে প্রক্রিয়ায় ঘটেছে, তাতে কি মনে হয়নি এদের পিছনে বিদেশী শক্তির মদদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক পক্ষকে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় করে দেয়াই ছিল ওই সরকারের প্রধান এজেন্ডা। তখন একটা অস্বাভাবিক সময় ছিল, জরুরী আইন বলবত আছে, সব রাজনৈতিক কর্মকা- বন্ধ। তার মধ্যে একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি বিশ্ব শান্তির পতাকা মাথায় জড়িয়ে ঢাল-তলোয়ারহীন অবস্থায় রাজনীতির মাঠে নেমে পড়লেন। বললেন, সারাদেশের মানুষ নাকি তাঁকে ক্ষমতায় দেখতে চান কিন্তু কয়েক দিন না যেতেই পিছু টান দিয়ে কোথায় চলে গেলেন, মানুষ তাকে আর খুঁজে পেল না। এসব ঘটনাগুলো কিসের আলামত, কি বার্তা দেয়। এগুলো বোঝার ক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের আছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই ও ২০০৩ সালে ইরাকে নূরী আল মালিকি, দুজন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা উড়ে এসে দুই দেশের ক্ষমতায় বসে গেলেন কিভাবে, কোন্ খুঁটির জোরে। এসব নিয়ে তখন বিশ্ব মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সৌভাগ্যের দিক হলো, দেশের বৃহত্তর সাধারণ জনগোষ্ঠী জাতীয় দুর্যোগের সময় এবং যখন তারা বুঝতে পেরেছে দেশের কোন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তখন জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে, অপতৎপরতা রুখে দিয়েছে। যার কারণেই এত বাধা-বিপত্তি, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আজ বিশাল সম্ভাবনার দেশে পরিণত হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহের সহযোগিতা ও সমর্থন আমাদের একান্ত প্রয়োজন। আর ঠিক এই সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যা ঘটেছে তাতে তখন দেশের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে, জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য হবে কয়েক বিলিয়ন ডলার। তখন ঋণ বাতিল না হলে ২০১৬ সালে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যেত। প্রায় তিন বছরের ডিভিডেন্ট জাতি পেল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জামায়াত, মুসলিম লীগ সহায়তা সহযোগিতা না করলে পাকিস্তান আর্মি এত ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারত না। ঠিক একইভাবে দেশের ভেতর থেকে যদি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে হাত মিলানো না হতো তাহলে বিশ্বব্যাংক এত বড় অবৈধ চাপ সৃষ্টি করতে পারত না, ঋণও বাতিল করতে পারত না। এর জন্য দেশের চক্রান্তকারীরাই বেশি দায়ী। তাই জাতীয় বেইমান ও চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন হওয়া দরকার। এ বিষয়ে হাইকোর্টের স্বপ্রণোদিত রুল জারিকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানাই। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, নিউআরলিনস, ইউএসএ
×