ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভাতফেরি

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রভাতফেরি

: আয়মান, যাবে? : কোথায় বাবা? : প্রভাতফেরিতে? : হ্যাঁ যাব। : তাহলে ওঠ। বাইরে যেতে বললে আয়মান খুব খুশি। বেড়াতে পছন্দ করে সে। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুল আর বাসা। বাসা আর স্কুল। এ ছাড়া আর কোথাও যাবার তার জায়গা নেই। তাই সে যে কোন জায়গায় যেতে বললে খুব খুশি। আজ আরও বেশি খুশি, কারণ সে যাবে প্রভাতফেরিতে। প্রভাতফেরি বললেই কানে বাজে সেই মায়াময় ডাক : প্রভাতফেরি প্রভাতফেরি আমায় নেবে সঙ্গে বাংলা আমার বচন আমার জন্মেছি এই বঙ্গে। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস। স্কুল বন্ধ। আজ সকাল সকাল বাইরে যেতে পারবেÑ এই খুশিতে সে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে তৈরি হয়ে পড়ে। বাবার আগেই সে প্রস্তুত। শীত যায় যায়। স্কুল বন্ধ থাকলে এমন দিনে আয়মান লেপের ভিতরে থাকে। তখন উমে ভরে থাকে শরীর। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। উমম! কিন্তু বাইরে যাওয়ার লোভে এমন মিষ্টি আরামকে ছুটি দিতে হচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখে অনেক মানুষ। তাদের মতোই। শীতের ভোরে হাঁটছে। যাচ্ছে এগিয়ে শহীদ মিনারের দিকে। কেউ একা, কেউ দল বেঁধে। বাবা জিজ্ঞেস করেন : হাঁটতে পারবে তো? : পারব। কোন কিছু ভাবার আগেই আরমান উত্তর দেয়। ওদের বাসা মেহেদিবাগ। শহীদ মিনার তাদের বাসা থেকে একটু দূরে। চট্টেশ্বরী মোড় ফেলে কাজীর দেউরী, তারপর জুবিলি রোড হয়ে সোজা নন্দনকানন। শহীদ মিনার এলাকাটি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। ওখানে আছে মুসলিম হল, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, স্টুডিও থিয়েটার, রাইফেল ক্লাব। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে শহীদ মিনার এলাকা জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় গ্রন্থমেলা। সবাই চেনে। সবাই জানে। বাবা তবু আয়মানকে বলেন : কিছু পথ রিকশায় চলো। কিন্তু না, আয়মান রিকশায় উঠবে না। মেয়েরা সাধারণত বাবার বেশি আদর পায়। তাদের আবদার-অনুযোগ সব শুনতে হয় বাবাকে। আজ আয়মানের তেমন আবদার নেই। কেবল ইচ্ছে : অন্যের মতো হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারে যাওয়া। হেঁটে চলেছে ওরা। যত সামনে যায়, তত বাড়ে মানুষ। হেঁটে চলার মানুষ। ওরা সবাই আয়মানদের মতো। খালি পায়ে হাঁটছে। কারও পায়ে জুতা নেই। হাঁটার মধ্যে কোন তাড়া নেই। আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটা শুরু করেছে এবার। গান গাইছে মানুষ। কেমন কান্না কান্না ভাব। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ আহা! বিষাদময় গান। আয়মানের কষ্ট হয়। শোকের গান শুনে তার মন ভরে ওঠে বেদনায়। আয়মানের মনে পড়ে যায় আরেকটি কবিতার কথা। শোকের কবিতা। শোক ততো অনুভব করতে না পারলেও সে বুঝতে পারে এটি বেদনার কবিতা। এটি পড়ে বুকে কষ্ট জাগে। কবিতাটির নাম ‘কাজলা দিদি’। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী। বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই?’ কোথায় গেলো কাজলা দিদি? পুকুর ধারে, নেবুর তলে থোকায় থোকায়, জোনাক জ্বলে, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই।’ আহ, কী কষ্ট ঢেউ খেলে যায় বুকে! দিদির হারিয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। এমন বেদনার কবিতার পর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান আয়মানের বুককে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি কি ভাইরা হারিয়ে গিয়েছিল? বাবা বলেন : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকায় ছাত্ররা মিছিল করছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। মিছিল করা নিষেধ ছিল। তবু ওরা নিষেধ মানে নি। সেøাগান ধরেছিল : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। তখন তাদের মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানের দুষ্ট শাসকরা। রক্তে লাল হয়ে ওঠে রাজপথ। তাদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষা। বাবার কথা মন দিয়ে শোনে আয়মান। পাকিস্তানী শাসকরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল? আমরা বাংলায় কথা বলতে পারতাম না? শহীদ হওয়া সেই সোনার সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হই আমরা। জল এসে যায় চোখে। বুকের কষ্ট আর চোখের জল একাকার। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি যেন আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের দিন। মানুষ হাঁটছে। শহীদ মিনারের দিকে। দলে দলে। সবার মুখে সেই কান্নার ধ্বনি : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।
×