ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিজস্ব রূপ হারাচ্ছে পুরান ঢাকা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নিজস্ব রূপ হারাচ্ছে পুরান ঢাকা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ সময়ের অগ্রযাত্রায় নিজস্ব রূপ হারাচ্ছে পুরান ঢাকা। ৪০০ বছরের পুরনো অলি-গলিতে ঘেঁষে থাকা দালানগুলো ভেঙে গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় এ্যাপার্টমেন্ট। এককালের শতবর্ষের পুরনো একতলা-দোতলা ভবন, ঘিঞ্জি অলিগলি, রাস্তার পাশে হোটেল-রেস্টুরেন্টে হাই ভলিউমে বাংলা-হিন্দি জনপ্রিয় গান বাজানো পুরান ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ছোট-বড় বিরিয়ানির দোকান, হোটেলের পরিবর্তে নতুন মাত্রা যোগাচ্ছে শহরের নামি-দামি চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলো। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পুরান ঢাকাবাসীও তাই উপভোগ করছে স্ব স্ব মহল্লার পরিবর্তন। খুপরী বিল্ডিংগুলোর ঘর থেকে বেরিয়ে অনেকে আবার বড় এ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিচ্ছেন। সঙ্গে পুরান ঢাকাবাসীর খাদ্যাভাসও আমূল বদলেছে। এখন তারা ঝাঁক বেঁধে আর বিরিয়ানির দোকানে ঢোকে না। বিভিন্ন চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলো তাদের এতিহ্যবাহী বিরিয়ানির দোকানগুলোকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত। বদলে যাচ্ছে পুরান ঢাকা। সেই সঙ্গে হারাচ্ছে ঐতিহ্য। সরেজমিনে পুরান ঢাকার লালবাগের লালবাগ কেল্লার মোড়, হরনাথ ঘোষ রোড, ঢাকেশ্বরী রোড, উর্দু রোড, খাজে দেওয়ান লেন, চকবাজার, জেলখানা রোডসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে চোখে পড়ল, ইট-সুরকির তৈরি পুরনো বাড়িঘর ভেঙে বড় বড় এ্যাপার্টমেন্ট, শপিংমল, কমিউনিটি সেন্টার ও মার্কেট নির্মাণ হচ্ছে। এসব ঘিঞ্জি অলিগলিতে একসময় ঘোড়া ও পরবর্তীতে রিকশাই ছিল এ এলাকার প্রধান যানবাহন। কিন্তু বর্তমানে পাড়া-মহল্লার এসব অলিগলিতেও দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি ছুটছে দিনভর। পুরান ঢাকাবাসীর পুরি, সিঙ্গারা ও বাকরখানি জাতীয় খাবার একসময় ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার পছন্দের তালিকায় থাকলেও এখন গুলশান ও বনানীর মতো নামী-দামী ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে প্রতিদিন ঢুঁ মারছেন মহল্লাবাসী। বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত কমিউনিটি সেন্টার কোনো অংশেই নতুন ঢাকার কমিউনিটি সেন্টারের মানের চেয়ে কম নয়। লালবাগ কেল্লার সামনে দেখা গেলো কয়েকটি চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট। কিংস কনফেকশনারী, ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট, ককটেইল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। সঙ্গে নতুন কয়েকটি রেস্টুরেন্ট নির্মাণাধীন রয়েছে। শীঘ্রই আমেরিকান বার্গার ও নবাবি ভোজের উদ্বোধন হবে। কয়েক বছর আগেও কেল্লার সামনে এ রেস্টুরেন্টগুলো ছিল না। পুরাতন কয়েকটি বাড়ি ছিল। সেগুলোও বড় বিল্ডিংয়ে রূপান্তর হয়েছে। ৬৫ বছরের বৃদ্ধ শাহজাহান মিয়া। শুক্রবার দুপুর ২টায় পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার বাড়িও লালবাগ কেল্লার এ রোডটিতেই। আলাপকালে তিনি বললেন, পুরান ঢাকা অহন বদলাইছে। আর পুরান ঢাকা নাইক্কা। এইহানে একসময় একতলা-দোতলার বাড়ি ছিল। মহল্লার সবাই সবাইরে চিনতো মাগার অহন পুরান সব বাড়িঘর ভাইঙ্গা নতুন নতুন বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট হইতাছে। কেউ কাউরে চেনে না। পুরান ঢাকা যেমতে পাল্টাইতাছে হেমতে মহল্লাবাসীর সম্পর্কেও চিড় ধরতাছে। ঢাকেশ্বরী রোডে প্রায় পাঁচটি নতুন বিল্ডিং উঠছে। একেকটি প্রায় ১০ থেকে ১২ তলা বিশিষ্ট। এ রোডেই একটি পুরাতন দোতলা বাড়ির মালিক তৌহিদ সরকার। তার বাড়ি এখনও পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বহন করছে। তিনিও কি অন্যদের মতো তার বাড়িটি ভেঙে নতুন বাড়ি বানাবেন কি-না জানতে চাইলে বললেন, ‘এইহানে থাইক্কাই প্রায় চল্লিশ বছর পার করলাম। বাব-দাদার বাড়ি পুরান হইছে মাগার বারবার রংচং করাইয়া নতুন বানাইছি। অহনও এ বাড়ি আমার কাছে নতুন লাগে। যেমনে পুরান ঢাকা বদলাইতাছে তাতে আমি ভাবতাছি এ বাড়ি ভাইঙ্গা নতুন বাড়ি বানাবো। আমার পোলাপাইনেও কইতাছে বাড়ি ভাঙতে। আমি সাঁই দিতাছি না। কিন্তু এমতে আর কয়দিন। এমনেতেও ফাটল ধরছে বাড়িতে। হয়তো ভাইঙ্গা ফেলমু।’ বায়ান্ন বজার তেপ্পান্ন গলির পুরান ঢাকার একেকটি রাস্তা, অলি-গলি কালের ঐতিহাসিক সব ঘটনার সাক্ষী। ঐতিহাসিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনায় এনে পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকাকে ঐতিহ্যবাহী ভবন বা স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এই হেরিটেজ বা ঐতিহ্যের তালিকা করে। একই সঙ্গে হেরিটেজ ঘোষিত এলাকা হিসেবে ঋষিকেশ রোড, রেবতি মোহন দাস রোড, বি কে দাস রোড, ফরাশগঞ্জ রোড, শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, পনিতলা, প্যারিদাস রোড ও হেমন্ত দাস রোডের নাম তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু সেসব সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। নজরদারির অভাবে ভেঙে সেখানে উঠছে বহুতল অট্টালিকা। উর্দু রোডের বাসিন্দা মোমিন শেখ বলেন, ‘খাওন-দাওন, এলাকার বাড়ি-ঘর সমেত পুরান ঢাকার পোলাপাইনও বদলাইছে। অহনকার পোলাপাইন ছাদে উইঠা ঘুড়ি উড়ানো ভুইল্লাই গেছেগা। আগের মতো আর ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়ায় না। বল নিয়া মাঠেও ছুটতে যায় না। সারাদিন কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মেবাইল ফোন নিয়া ব্যস্ত থাকতাছে পোলাপাইন। আস্তে আস্তে পুরান ঢাকা মনে হই একেবারেই বদলাইয়া যাইবোগা। আধুনিক প্রযুক্তি পুরান ঢাকার মানুষকে বন্দি জীবনে অভ্যস্ত করে ফেলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। চকবাজারের এক হোটেল ব্যবসায়ী কাশেম বিশ্বাস বলেন, ‘মহল্লার মানুষজন আগে নাস্তায় ডাল-পুরি, সিঙ্গারা, চা ও বিরিয়ানি খাইলেও অহন এসব খাবার পোলাপাইনে খাইবার চাই না। ফাস্টফুড ও চাইনিজ ও নামী-দামী দোকানের খাবার খাইতাছে। সব পোলাপাইন অহন বিদেশি হইয়া গেছে। নিজস্ব খাবারে মন নাইক্কা।’ ঢাকা শহরের আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ভোজনরসিক মানুষের বরাবরই খেতে আসেন পুরান ঢাকায়। কিন্তু কালক্রমে পুরান ঢাকা ভোজনরসিক মানুষেরাই তাদের নিজস্ব এতিহ্যের খাবার যেমন- বিরিয়ানি, কাবুলি, খিচুড়ি, শিরবিরঞ্জ, হালিম, বাকরখানি রুটি, চালের গুঁড়ার পিঠা, দোলমাজাতীয় তরকারি ইত্যাদি ভুলে মন দিয়েছে-চাইনিজ, বার্গার, পিৎজা, স্যুপ ইত্যাদি খাবারে। পুরান ঢাকাবাসীদের পোশাকেও যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। পুরুষরা ধূতি, লুঙ্গি, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি এবং মহিলারা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পর্দা হিসেবে বোরকার ব্যবহার ইত্যাদি পুরান ঢাকার রেওয়াজ থাকলেও এখন এলাকাবাসী অত্যাধুনিক পোশাক পড়তে অভ্যস্ত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তরুণ-তরুণী ও মহিলারা ঝলমলে জরিদার পোশাক পরলেও ধরন বদলেছে পোশাকের ডিজাইনে। এছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে সদ্য গড়ে উঠেছে বিউটি পার্লার। যেগুলো গুলাশার-বনানীর বিউটি পার্লারগুলোর চেয়ে কম যায় না। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে পুরান ঢাকা আর নতুন ঢাকা একাকার হয়ে যাচ্ছে।
×