ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

ছুটিরদিন সকালটা ছিল ছোটদের, বিকেল বড়দের

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ছুটিরদিন সকালটা ছিল ছোটদের, বিকেল  বড়দের

মনোয়ার হোসেন ॥ বসন্তের বাতাসে যেন দুরন্ত গতি পেয়েছে একুশের বইমেলা। লেখক-পাঠক ও প্রকাশকের সরবতায় ধারণ করেছে দারুণ লাবণ্য। এখন খরস্রোতা নদীর মতো এগিয়ে চলেছে বাঙালীর মনন প্রকাশের মেলাটি। পয়লা ফাল্গুন ও ভালবাসা দিবস পেরিয়ে রয়েছে জমে ওঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে। শুক্রবার ছুটির দিনে দুই রূপে আবির্ভূত হয়েছে গ্রন্থমেলা। বিপুলসংখ্যক খুদে পাঠকদের আগমনে সকালবেলার শিশুপ্রহরটি ধরা দিয়েছে বর্ণময়তায়। ছোট ছোট পাঠকরা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছে মেলাজুড়ে। এরপর মনের খোরাক মেটাতে বইয়ের রাজ্যে ডুবে গিয়েছে শিশু-কিশোর ছোট ছোট বইপ্রেমীরা। বাবা-মা কিংবা মামা-চাচার হাতের বাঁধনটি আলগা করে স্টলে স্টলে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছে পছন্দের বইটি। এত গেল সকালের কথা। বিকেলবেলায় ভিড় জমিয়েছিল পরিণত পাঠকেরা। শহরের নানা প্রান্ত থেকে আসা গ্রন্থ অনুরাগীদের সঙ্গে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে বিকেলের পর্ব। মেলার দুই ক্যানভাস সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি আঙিনায় ছিল জনস্রোত। পাঠকের হাতে হাতে দেখা গেছে বইয়ের সম্ভার। প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় ছিল বইপড়ুয়াদের জমজমাট ভিড়। বইয়ের ব্যাপক বিকিকিনিতে দেখা গেছে প্রকাশকের স্বস্তি মাখা চওড়া হাড়ি। শুক্রবার বেলা ১১টায় খুলে যায় মেলার দ্বার। বসন্ত সকালের ঝলমলে রোদে বইয়ের সন্ধানে আসা সোনামণিদের পদচারণায় রূপময় হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিশু কর্নারটি। এখানে বই কেনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বটগাছতলার সিসিমপুর মঞ্চের আনন্দময়তা। হালুম, টুকটুকি ও ইকরির সঙ্গে দুষ্টুমি করে কেটেছে শিশুদের মজার সময়। এরপর ছোট ছোট পদক্ষেপে প্রতিটি বই বিতান ঘুরে ঘুরে এ বই সে বই ঘেঁটে সংগ্রহ করেছে পছন্দের বইটি। টোনাটুনি, ছোটদের মেলা, ঝিঙে ফুল, শিশু ঘর, পাতাবাহার, ওয়ার্ল্ড অব চিলড্রেন্স বুক নামের দোকানগুলোর প্রতি ছিল খুদে পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ। এছাড়া শিশু চত্বরের বাইরে থাকা সাহিত্য প্রকাশ, কথাপ্রকাশ পাঞ্জেরী, অবসর ও অ্যাডর্নসহ বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থাগুলো শিশুতোষ গ্রন্থের সন্ধানে ঢুঁ মেরেছে খুদে পাঠকরা। এভাবে ঘুরে ঘুরে তারা সংগ্রহ করেছে রূপকথার গল্প থেকে শুরু করে, কল্পবিজ্ঞান, ছড়ার বই, এ্যাডভেঞ্চার, ভূতের গল্প, ম্যাজিক বুক, ঠাকুরমার ঝুলি, টোনাটুনি কিংবা ঈশপের গল্পের বই। ছোটদের উপযোগী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের প্রতিও ছিল অনেকের প্রবল ঝোঁক। কথা হয় দুই হাতে বই নিয়ে ঘুরতে থাকা দুই বোন অথৈ ও ঐশীর সঙ্গে। কেমন লাগছে জানতে চাইলে মিষ্টি হাসি দিয়ে দু’জন মিলে বলে ওঠে, বইমেলার এই দিনটা তো শুধু আমাদের জন্য। তাই মজা তো লাগবেই। সেই আনন্দে গাছভূত, রূপকথা ও জোকসের বই কিনে ফেলেছি। আরও কিনব ছড়া ও কল্পবিজ্ঞানের বই। পাঠক ও দর্শনার্থীর আগমনে বিকেলে মেলাটি রীতিমতো জনারণ্যে পরিণত হয়। সেই সুবাদে বইয়ের বিকিনিও হয়েছে প্রচুর। দুই হাত ভর্তি বইয়ের ব্যাগ নিয়ে পথ চলতে গেছে অনেক গ্রন্থপ্রেমীকে। এদিন পাঠকের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন লেখকেরও দেখা মিলেছে মেলায়। প্রথমা প্রকাশনীর স্টলে বসে পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে নিরন্তর অটোগ্রাফ দিয়ে গেছেন এ সময়ের জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক। একইভাবে অনন্যা প্রকাশনীর স্টলে বিকেল থেকে অবধি নিজের বইয়ের ওপর অটোগ্রাফ দিয়েছেন আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্যপুরস্কারপ্রাপ্ত কবি আবু হাসান শাহরিয়ার জমিয়ে আড্ডা দিয়েছেন অনুরাগীদের সঙ্গে। এছাড়া এদিনের মেলায় হাজির হয়েছিলেন কবি অসীম সাহা, কবি কাজী রোজী, ছড়াকার আসলাম সানী, সুমন্ত আসলামসহ বেশ কিছু লেখক। শেষ বিকেলে একের এক পাঠককে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন আনিসুল হক। ভিড়ের মাঝেই তার নতুন উপন্যাস ‘প্রিয় এই পৃথিবী ছেড়ে’র পাতায় স্বাক্ষর দিতে দিতে বললেন, বর্তমানে বিপুল বেগে এগিয়ে যাচ্ছে একুশে গ্রন্থমেলা। এবারের মেলাকে অনেকটা উড়োজাহাজের উড্ডয়নের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। উড়োজাহাজ যেমন ভূমি থেকে ধীরে ধীরে আকাশে ওড়ার তুমুল গতিতে এগিয়ে চলেÑ সতেরোতম দিনে এসে মেলা অবস্থাও সে রকম। এখন যারা আসছেন বেশিরভাগই বই কিনছেন। আর এই বিপুলসংখ্যক পাঠকের আগমনে সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কেমন হলো শুক্রবারের মেলা- এ প্রশ্ন ছিল জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান শায়কের কাছে। তৃপ্তি ভরা হাসিমুখ অবশ্য আগেই জানান দিচ্ছিল, শুক্রবারের মেলা দারুণ হয়েছে। হাসিমুখ ধরে রেখেই বললেন, এবারের মেলার প্রথম দিনেই ছিল বইপ্রেমীদের ঢল। কিন্তু আজকের (শুক্রবার) মেলায় জনবিস্ফোরণ ঘটেছে। এ বছরের মেলার সবচেয়ে বেশি জনসমাগম ঘটেছে আজ। পাঠকেরা সারিবদ্ধভাবে মেলায় শুধু ঢুকছেই না, প্রায় সবাই হাতে করে নিয়ে যাচ্ছেন বই। সামনের দিনগুলো এ বিক্রি আরও বাড়বেÑ এমনটা সহজেই প্রত্যাশা করা যায়। একই রকম সন্তুষ্টি ও প্রত্যাশার কথা জানান ইত্যাদি প্রকাশনের প্রকাশক আদিত্য অন্তর। আজ শনিবার মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকবে শিশুপ্রহর। নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী শুক্রবার মেলায় ২৪১টি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ৩২, উপন্যাস ২৭, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ৭৭, গবেষণা ১১, ছড়া ৯, শিশুসাহিত্য ৭, জীবনী ৪, মুক্তিযুদ্ধ ৪, নাটক ১, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ৫, ইতিহাস ৫, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ৪, অনুবাদ ১, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ৩ এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর আরও ৪টি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে মোশতাক আহমেদের ‘নরেন্দ্র জমিদারের যুগে’ (পাঞ্জেরী), ইমদাদুল হক মিলনের ‘হাতি গিয়েছিলো মানুষ দেখতে’ (পাঞ্জেরী), আনিসুল হকের ‘গুড্ডু বুড়োর চোরধরা’ (শুভ্র প্রকাশ), ব্রি. জে. এম শাখাওয়াত হোসেনের ‘সন্ত্রাস : দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য’ (পালক), পিয়াস মজিদের ‘মনীষার মুখরেখা’ (মাওলা ব্রাদার্স), শাকুর মজিদের ‘পৃথিবীর পথে পথে’ (গ্রন্থ কুটির), শিহাব সরকারের ‘হাত বাড়ালেই সূর্য’ (নবযুগ), বদিউল আলম মজুমদারের ‘রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে করণীয়’ (আগামী), আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর ‘খুশবন্ত সিংয়ের জোকস’ (নালন্দা), রাসেল আশেকীর ‘পোশাকে লুকানো দুঃখগুলো’ (শান্তির প্রবেশ প্রকাশনা)। মেলামঞ্চের আয়োজন : শুক্রবার গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আশির দশকের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি কুমার চক্রবর্তী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. মাসুদুল হক এবং ড. আমিনুর রহমান সুলতান। সভাপতিত্ব করেন কবি রুবী রহমান। আজকের অনুষ্ঠান : আজ শনিবার সকালে অমর একুশে উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব।
×