ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আনিসুজ্জামান আজ ৮১তে পা দিলেন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ড. আনিসুজ্জামান আজ ৮১তে পা দিলেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সময়ের এক আধুনিক মানুষ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। তাঁর হাতে প্রাণ পেয়েছে এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন। জ্ঞানের চর্চায় আলোকিত করেছেন শিক্ষার ক্ষেত্র। সাংস্কৃতিক পরিম-লের বিকাশে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতির বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব পাড়ি দিলেন জীবনের আশিটি বছর। মেধা ও মননে ঝলমলে এক দীর্ঘ জীবন পরিভ্রমণে আজ শনিবার তাঁর ৮০তম জন্মবার্ষিকী ও ৮১তম জন্মদিন। বাংলা একাডেমির সভাপতি ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় পরিবারের পক্ষে এই শিক্ষাবিদের জন্মদিনে কোন আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামানের মেয়ে শুচিতা জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি বাবা ব্যাংকক থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। চিকিৎসকরা বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। বর্তমানে বাবার শরীরের অবস্থাও ভাল নয়। এ কারণে পারিবারিকভাবে জন্মদিন উদযাপনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এছাড়া জন্মদিনকেন্দ্রিক আয়োজনে তাঁর যোগদানের বিষয়টিও বাতিল করা হয়েছে। এদিকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার তাঁর জীবন ও কর্মভিত্তিক তথ্যচিত্র বাতিঘরের প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ড. আনিসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটের এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যময় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ডা. এ টি এম মোয়াজ্জেম পেশায় ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ডাঃ মোয়াজ্জেম লেখালেখিও করতেন। মা সৈয়দা খাতুন, গৃহিণী হলেও তাঁরও ছিল লেখালেখির অভ্যাস। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তাঁর বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। সবমিলিয়ে শিল্প-সাহিত্যের আলোয় সমৃদ্ধ এক পরিবারের সন্তান জাতির ক্রান্তিকালের বাতিঘর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্ত্রী সিদ্দিকা ওহাব, দুই মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং একমাত্র ছেলে আনন্দ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রচ- মেধাবী ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ১৯৫১ সালে নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করে বাংলায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। একই পরীক্ষায় কলা অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’। স্নাতকোত্তর পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পিএইচডি গবেষক হিসেবে বৃত্তি পান। অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালী মুসলমানের চিন্তাধারায় ১৭৫৭-১৯১৮’। তিনি ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমির সেই বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এ্যাডহক ভিত্তিতে তিনমাসের জন্য যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ এ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। বর্তমানে তিনি একই বিভাগে প্রফেসর ইমিরেটাস পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। এ ছাড়া শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার কার্যক্রমে তিনি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগনামা পাঠ করেছিলেন। এই ভূমিকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। দেশদ্রোহিতার মামলা হয়েছিল। আনিসুজ্জামানের হাতে বাংলা গদ্যের প্রমিত ও উৎকর্ষম-িত আদর্শ রূপ একটি মানদ-ে দাঁড়িয়েছে। গভীর জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে তিনি যে কোন বিষয়কে অত্যন্ত সহজবোধ্যভাবে সাবলীল ভাষায়, সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরতে পারেন। যে কোন কঠিন বিষয়কেও সহজভাবে তুলে ধরতেও অত্যন্ত পারদর্শী এই বিদ্বান ব্যক্তি। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে লিখেছেন অসংখ্য বই। প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। তাঁর রচিত ‘আমার একাত্তর’ ও ‘কাল নিরবধি’ নামের দুই স্মৃতিকথাভিত্তিক গ্রন্থকে বলা যায় সময়ের দলিল। অনুবাদ করেছেন দুটি নাটক। অস্কার ওয়াইল্ডের ‘এ্যান আইডিয়াল হাজব্যান্ড’-এর অনুবাদ করেছেন ‘আদর্শ স্বামী নামে। আলেক্সেই আরবুঝভের ‘স্তারোমোদোনাইয়া কোমেদিয়া’ নাটকের অনুবাদ করেছেন ‘পুরনো পালা’ শিরোনামে। আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ স্মারকগ্রন্থ, নারীর কথা, মধুদা, ফতোয়া, ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ, আইন-শব্দকোষ অন্যতম। তাঁর শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যা দুটি। সম্পাদনা করেছেন সাঁইত্রিশটি গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি-লিট। শিক্ষা ও সাহিত্য অবদানের জন্য পেয়েছেন ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ। তাঁর উল্লেখযোগ্য স্মারক বক্তৃতার মধ্যে রয়েছেÑ এশিয়াটিক সোসাইটিতে (কলকাতা) ইন্দিরা গান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইন্সটিটিউট অফ এশিয়ান এ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা এবং অনুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা।
×