ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানবপাচারের শিকার যারা তারাই নেমেছেন প্রতিরোধে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মানবপাচারের শিকার যারা তারাই নেমেছেন প্রতিরোধে

তৌহিদুর রহমান, কক্সবাজার থেকে ফিরে ॥ এক সময় যারা মানবপাচারের শিকার হয়েছিলেন, তারাই এখন এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নেমেছেন। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে যারা সাগর পথে ট্রলারে করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তবে কোন রকমে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন। সেই সব যুবকই সচেতনতা বাড়াতে এখন কাজ করছেন। কেউ যেন সাগর পথে বিদেশে পাড়ি না জমায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন এসব যুবক-যুবতী। ফলে কক্সবাজার এলাকা থেকে মানবপাচার এখন অনেকটাই কমে এসেছে। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন কক্সবাজারের রামু এলাকার তরুণ মোঃ ফোরকান। দালালের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। তারই এলাকার একজন দালাল টেকনাফের আরেক দালাল আবদুল করিমের কাছে তুলে দেয় তাকে। টেকনাফ থেকে ছোট ট্রলারে করে তাকে তুলে দেয়া হয়। এই ছোট ট্রলার থেকে পরে সাগরে রাখা বড় ট্রলারে তুলে দেয় দেয়া হয়। মোট ২২৮ জনকে নিয়ে রওনা হয় সেই ট্রলার। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তারপর সেই ট্রলার ভিড়ে থাইল্যান্ডের এক জঙ্গলে। সেখানেই বন্দী করে রাখা হয় তাদের। এরপর তাদের পরিবারের কাছে মোটা অংকের অর্থ দাবি করা হয়। নির্যাতনও চলে। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন, সেখানেই। অবশেষে থাইল্যান্ডের পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। পরে থাইল্যান্ডের দূতাবাসের মাধ্যমে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কক্সবাজারের সিরাজুল ইসলামের ঘটনাও একই রকম। সংসার চলে না। তাই সিদ্ধান্ত নেন বিদেশে পাড়ি জমাবেন। ২০০৮ সালে যাত্রা করেন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। ট্রলারে করে তারাও পাড়ি জমান। এক সময় আন্দামান দ্বীপে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। আন্দামান দ্বীপের অধিবাসীরা তাদের উদ্ধার করেন। তারপর আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্ট সংস্থার সাহায্যে ফিরে আসেন তারা। বৃহস্পতিবার কক্সবাজার শহরে পাচারের শিকার হওয়া ফোরকান ও সিরাজুলের সঙ্গে বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীর আলোচনা হয়। তাদের মতোই আরও বেশ কয়েকজন যুবক-যুবতীর সঙ্গেও আলাপ হয়। পাচারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ইসহাক ও সুমন বড়–য়া। অভিজ্ঞতা একই রকম। ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা শুনলে শরীর শিউরে উঠে। কোন রকম জীবন নিয়ে যে দেশে ফিরে আসতে পারবেন, তার কোন আশা ছিল না। সেই কারণেই দেশে ফেরার পরে তারা এখন সংগঠিত হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন অনির্বাণ নামে একটি সংগঠন। ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে সংগঠনটি। কেউ যেন আর অবৈধভাবে ট্রলারে করে বিদেশে না যান, সেই বিষয়ে সচেতনতা আনতে কাজ করছেন তারা। ট্রলারযোগে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা এই অঞ্চলের বহুদিনের। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু প্রভৃতি এলাকার মানুষ দালালদের সহায়তা নিয়ে ট্রলার যোগে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে থাকেন। রোহিঙ্গারাও ট্রলারযোগে পাড়ি জমান এখান থেকে। তবে ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে গণকবর উদ্ধারের পর থেকে টনক নড়ে সবার। বিদেশে যাওয়ার সময় মানবপাচারকারীরা তাদের বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকেন। মুক্তিপণ নেয়ার পরে অনেককেই মেরে ফেলেন। আবার কেউ কেউ খাবার না পেয়ে সাগরেই মৃত্যুবরণ করেন। আবার অনেককেই মারার পর থাইল্যান্ডের জঙ্গলে কবর দেয়া হয়। সে ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। মানবপাচারের শিকার অনেকেই ফিরিয়ে আনা হয়। তবে ওই অঞ্চলের আর কেউ যেন মানবপাচারের শিকার না হন, সেই কারণেই পাচারের শিকার যুবক-যুবতীরা সচেতনতা আনার জন্য কাজ করছেন। মানবপাচার প্রতিরোধের লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে মোঃ ফোরকান জনকণ্ঠকে বলেন, মানবপাচারের শিকার হওয়া যুবক-যুবতীদের নিজেদের অভিজ্ঞতা অন্যকে জানালে, সহজেই কেউ এই পথে আর পা বাড়াবে না। সে কারণেই তাদের এই উদ্যোগ। কক্সবাজারে মানবপাচার প্রতিরোধে সহায়তা দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা- ইউএসএইড। আর তাদের সহায়তায় উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ‘বাংলাদেশ কাউন্টার ট্রাফিকিং ইন পারসন’ (বিসিটিআইপি) কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। মানবপাচার বন্ধ করা, নিরাপদ শ্রম অভিবাসন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করছে তারা। কক্সবাজারের বেসরকারী সংস্থা ইপসাও মানবপাচারের শিকার হওয়া যুবক-যুবতীদের সংগঠন অনির্বাণকে সহায়তা দিয়ে আসছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় বিভিন্ন সংস্থা মানবপাচার প্রতিরোধে কাজ করছে। এলাকায় এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে চাইছে এসব সংগঠন। কেউ যেন কোনভাবেই প্রলোভনের শিকার হয়ে ট্রলারযোগে বিদেশে না যান, সেই বিষয়েও কাজ করছে তারা। সেখানেও মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা পরিচালনা করছে পিটিসিসি কর্মসূচী। আর এই কর্মসূচী বাস্তবায়নে সহায়তা দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএইড।
×