ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী’র গুপ্তচর

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রাজশাহী’র গুপ্তচর

(পূর্ব প্রকাশের পর) আওরঙ্গাবাদে শেষ রাতের আকাশে ক্ষয়া চাঁদটা তখনো ভেসে আছে। একমাত্র রাতজাগা মানুষ ছাড়া সেই চাঁদের সৌন্দর্য কেউ খেয়াল করে না। অসময়ে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় আওরঙ্গজেব তা লক্ষ্য করলেন। মাঝে মাঝে বরফের টুকরোর মতো ঘন ধবধবে সাদা মেঘের সঙ্গে হলুদ চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি কি কোন সংকেত পাঠাচ্ছে? মুহূর্তেই বাস্তবে ফিরে এলেন আওরঙ্গজেব। তাই তো? কি যতসব বদনসিব স্বপ্ন নিয়ে পেরেশান হয়ে আছেন। সময় তো এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। সামান্য ভুলের জন্য অনেক বড় মাশুল গুনতে হবে। এই মুহূর্তে পুরো হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে থাকা তাঁর বিশ্বস্ত গুপ্তচর’রাই ভরসা। তুরস্কের অটোমান সুলতান আর বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের এই প্রাচীন কায়দা আওরঙ্গজেবের নিজস্ব কানুনে আজ পর্যন্ত খুব কাজ দিচ্ছে। প্রশিক্ষিত কবুতরের মাধ্যমে চিঠি চালাচালি’র পাশাপাশি গুপ্তচরদের আনা সংবাদের উপর ভিত্তি করেই তিনি ঠিক করে থাকেন পরবর্তী পদক্ষেপ। এমনকি তাঁর কাছের উজির-সেনাপতি সবার পেছনেই তিনি গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছেন। সঠিক ঘটনা তাঁর জানা চাই-ই চাই। প্রয়োজনে রাজকোষের সমস্ত মুদ্রা তিনি ব্যয় করবেন। দিল্লীর তখত কায়েম করতে চাইলে খোদার মেহেরবানি ছাড়াও এই গোপন-কানুনের বিকল্প নেই। কিন্তু গত কয়েকদিন তিনি নতুন কোন খবর পাননি। আব্বাহুজুর দিল্লিতে দারা-জাহান আরা’র হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন এবং পাক্কা খবর পেয়েছেন সম্রাট সুস্থ হতে চলেছেন। তবে বিশদ আরো জানা বাকি। ওদিকে মুরাদ বয়স্ক মন্ত্রী আলী নকী’কে বেকুবের মতো হত্যা করেছে তা খোদ মুরাদের বিশ্বস্ত গুপ্তচর তাঁদের জানিয়ে গেছে। - হায় অদৃষ্ট! কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করলেন ঊনচল্লিশ বছরের বুদ্ধিমান শাহজাদা। ফজরের নামাজের শেষে কোরআন তেলাওয়াতের মাঝখানে আওরঙ্গজেব টের পেলেন দরজার পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। ধ্যান ভেঙ্গে গেল। ‘ফাবি আইয়ে আলা ইরাব্বিকা মা তুকাযয্বেবান ...’ কোরআন শরিফের অসমাপ্ত পাতায় ময়ূরের পালক গুঁজে ডেকে নিলেন প্রহরীকে। - খুদা বক্স আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী হুজুর। চেহারায় প্রসন্নতা ফিরে এলো আওরঙ্গজেবের। - কি বলছো তুমি? শাহ সুজা সত্যি এটা করেছেন? গুপ্তচর খুদা বক্সের কাছ হতে সংবাদটা পেয়ে বিস্মিত হলেন আওরঙ্গজেব। মাঝরাতে সঙ্গে একজন ঘোড়সওয়ার নিয়ে খুদা বক্স আওরঙ্গাবাদে এসেছেন সরাসরি ঢাকা হতে। দ্রুতগামী ঘোড়ায় তাদের সাত দিন লেগেছে পৌঁছাতে। খুদা বক্স সুজার দরবারে কাজ করেন আওরঙ্গজেবের পক্ষ হয়ে। ভোর হবার আগেই যাবতীয় সংবাদ তার মনিবকে পৌঁছে দিয়ে সকাল হবার আগেই প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাবে, কেউ যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে। - জ্বী হুজুর। সুবেদার সুজা যখনই খবর পেলেন দিল্লি-ই-ইলাহী ইন্তেকাল করেছেন তার পরদিনই নিজেকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ ঘোষণা করেছেন। মসজিদে প্রতি জুম্মায় তাঁর নামে খুদবা পাঠ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় মহামান্য, তিনি তাঁর পদবীতে নতুন স্বর্ণ মুদ্রা চালু করেছেন। আস্তিনের ভেতর হতে এক মুঠো মুদ্রা আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দিল খুদা বক্স। মোমের আলোয় একটি মুদ্রা পরীক্ষা করে দেখলেন আওরঙ্গজেব। চকচকে মুদ্রায় সুজা’র নাম খোদিত। খুদা বক্স ঠিকই বলেছে। - কিন্তু আমার বেকুব ভাইটি কি জানেন না সম্রাট সুস্থ হয়ে উঠছেন? যে খবরটা দিল্লির একটা বাচ্চা ছেলে জানে সেটা উনি কেন জানলেন না? ব্যাপারটা কি? - হতে পারে তিনি সম্রাটের সুস্থ হবার সংবাদটি মোটেও জানেন না অথবা জানলেও ইচ্ছে করে ভাব দেখাচ্ছেন তিনি কিছুই জানেন না। তবে শেষের ধারণাটা অমূলক নয় হুজুর। বারো দিন আগে যখন তিনি শিকারে যান তখনও জেনেছিলেন সম্রাট সুস্থতার পথে। তবে শিকার হতে ফিরে এসেই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন। খুদা বক্স ব্যাখ্যা করতে থাকলো তার বিশ্লেষণ। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আওরঙ্গজেব। - খবরটা আমাকে দিয়ে তুমি যথার্থ কাজ করেছো। সুজা জানুক বা না বুঝুক তাঁর মূল ইচ্ছেটাই প্রকাশ করেছেন। সম্রাটের সুস্থতা তাঁর কাছে কোন বিষয় নয়। তুমি কোন বাহক না পাঠিয়ে সরাসরি আমাকে জানিয়ে হিন্দুস্তানের অনেক খেদমত করেছো। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে আমার ভাই আমাদের এত্তেলা পাঠিয়ে তাঁর বাদশাহী ফরমান পাঠাবেন। তার আগেই আমি চিন্তা-ভাবনা করার সময় পেয়ে যাবো। ঠোঁটে বিদ্রƒপের হাসি খেলে গেল আওরঙ্গজেবের। একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, - ভাল কথা। তোমার জায়গীর কোন এলাকায়? - রাজশাহীতে হুজুর। - কোথায় ওটা? বর্ধমানের পূর্ব দিকে? - জ্বী হুজুর। মাথা নাড়লো খুদা বক্স। - ওহ! ওটা তো একদম বাংলা মুলুকের মাঝখানে। তুমি তো তাহলে ওখানকার জমিদার। দাক্ষিণাত্যের ভেতর হলে আমি তোমাকে আরো জায়গীর দান করতাম। দেখি কি করা যায়। এক টুকরো বিশেষ কাগজে সাংকেতিকভাবে আওরঙ্গজেব নিজের নাম স্বাক্ষর করে সীলমোহর দিলেন। - নাও এটা। যাবার সময় আমার রাজকোষে জমা দিলে তোমাকে পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে দেবে। ঝলমল করে উঠলো খুদা বক্সের চেহারা। - ধন্যবাদ মহামান্য। খোদা আপনার মঙ্গল করুন। - মনে রাখবা, আওরঙ্গজেব জানেন কিভাবে বিশ্বস্তদের পুরস্কৃত করতে হয়। এখন নিরাপদে তোমার জায়গায় চলে যাও আর জানাতে থাকো কি কি ঘটছে। খোদা হাফেজ ...। ইশারা করলেন শাহজাদা। খুদা বক্স চলে যাবার পর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন আওরঙ্গজেব। কেন সুজা আগেভাগে এই চালটি দিলেন? আওরঙ্গজেব জানেন শাহ সুজা এতো বোকা নন, যতটা ভাবা হয়। নাকি বাংলার কাদা-পানিতে থাকতে থাকতে সুজার মগজে শ্যাওলা জন্মেছে? অথবা সুজা কি ভেবেছেন পুরো হিন্দুস্তান তাঁর পশু-পাখি শিকার করার জঙ্গল? আওরঙ্গজেব আরো শুনতে পেরেছেন শাহজাদা সুজা মেয়েমানুষের ক্ষেত্রে মোটেও যাচাই-বাছাই করেন না। এটা কি করে সম্ভব? এমন দূষিত মুঘল রক্ত কি ময়ূরসিংহাসনের উপযুক্ত? পায়চারি থামিয়ে আওরঙ্গজেব থমকে দাঁড়ালেন। তিনি আন্দাজ করতে পেরেছেন সুজা আদতে দিল্লির বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলা সম্পদশালী এলাকা। এই সম্পদ কাজে লাগিয়ে দিল্লি জয় করতে চান সুজা। একবার দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে সুজা’কে ঠেকানো সম্ভব নয়। দারা’র নমনীয়তার চেয়ে সবাই সুজার সাহসিকতাকেই প্রাধান্য দেবে। কিন্তু দিল্লির রাজকীয় বাহিনীকে কি সুজার বাংলার ফৌজ পরাজিত করতে সক্ষম হবে? আওরঙ্গজেব অধৈর্য হয়ে উঠলেন। সময়ক্ষেপণ না করে মুরাদের মনোভাবটা আগে বুঝে নিতে হবে। তারপর বাকী কাজ। ততক্ষণে সকালের আলো ফুটে উঠেছে। একই সূর্যের আলো দিল্লির লাল কেল্লায় ঘুম ভাঙ্গালো বাদশাহ শাহজাহানের। তিনি ভোরবেলায় এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছেন। ‘সবার আগে এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত আদরজান জাহান আরা’কে জানাতে হবে...’ ভাবতে ভাবতে ঘুম ভাঙ্গা চোখে মাঝরাতে আধ-খাওয়া মদের পাত্রটিতে হাত বাড়ালেন দিল্লির বাদশাহ। (চলবে)
×