ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

একটি গান ও বিজ্ঞান

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একটি গান ও বিজ্ঞান

বাউল শিরোমণি লালন তার অনেক গানে দিব্য জ্ঞানের কথা বলে গেছেন; আধুনিক এই যুগে যখন বাস্তবতা মানুষকে কাঁটালতার মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে তখন তার অতল নিগূঢ় গান আরও বেশি রহস্যের গভীরে নিয়ে যায় আমাদের। লালনের সুবিখ্যাত গান হচ্ছে- বাড়ির কাছে আরশিনগর’ যা যেমন এর লোক প্রিয়তায় অনন্য তেমনি দ্ব্যর্থকতায়, দার্শনিক গভীরতায় অসামান্য একটি গান হয়ে আছে। ব্যক্তির দেহ আর মনের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক আবার যোজন যোজন ফারাক তা লালন মৃন্ময় ও চিন্ময়রূপে দেখিয়েছেন। বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথায় পরশির বসবাস কিন্তু বেদনার বিষয় হচ্ছে লালন বিরাট প্রবঞ্চনায় ব্যর্থ কারণ সে তার পরশিকে কোন দিনই দেখতে পারে না। বাড়িকে যদি আমরা দেহ হিসেবে দেখি তবে আরশিনগর হচ্ছে মন বা আত্মা। এই দেহ আর আত্মার মিলন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। কিন্তু আমাদের আত্মা ইন্দ্রিয়াতীত তাকে বোঝা বা জানতে পারার বোধের মাঝেই আমাদের যাতনা দূর করবে যা সাধারণে সম্ভব নয়; মরমীদের মতে এই আত্মার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসীম। বাড়ি বা দেহ হচ্ছে সাময়িক আর আত্মা অবিনশ্বর। আমরা একে কম্পিউটারের হার্ডওয়ার আর সফটওয়ারের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কম্পিউটারের দেহ, হার্ডওয়ার বা সিপিইউ ধ্বংস হয়ে গেলেও এর সফটওয়ারকে আমরা অন্যখানে নিয়ে ব্যবহার করতে পারি; এমনিভাবে আমাদের দেহ নশ্বর কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর কিন্তু তাকে বোঝা সাধারণ জ্ঞানে সম্ভব নয়। বিজ্ঞানও এই আত্মার রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থ; যেমনিভাবে আমরা দেখেছি ঈশ্বরকণার রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা বারেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। তেমনিভাবে অসীমকে খুঁজে পেতেও ব্যর্থ আমাদের সসীম মন। লালনের মতে আমরা যদি রিপুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি তবে আমাদের এই ক্ষুদ্র সত্তার মাধ্যমেই অসীম সত্তার আভাস পেতে পারি। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই সম্পর্কের ব্যাপরটি লালনের গানের খুব সাধারণ একটি বিষয়; কিন্তু লালনের আরশিনগর গানটির সুগভীর মর্মার্থ আছে যা এই উত্তর-আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক ধারণার সঙ্গে তুলনীয়। মরমী দর্শন লালনের আরও অনেক গানেই বিদ্যমান কিন্তু আরশিনগর গানটিকে আমরা নানান মাত্রায় আলোচনায় আনতে পারি। আকারের মাঝে নিরাকার যে নানা ব্যঞ্জনা নিয়ে মধুর গভীর অনন্ত খেলা খেলে যাচ্ছে তার ব্যাকুলতা এ গানটির মূল একটা বিষয়। লালনের গানের আরশিনগর আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের তুমুল আলোচিত প্যারালাল জগতের ইঙ্গিত দেয়। বিজ্ঞানের ভাষায় প্রতিটি বস্তুর এক সমান্তরাল বস্তু রয়েছে যেমন কায়া বা আকৃতির ছায়া রয়েছে কায়া ধরা যায় কিন্তু ছায়া ধরা যায় না শুধু দেখা যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই পৃথিবীর এক সমান্তরাল পৃথিবী রয়েছে; ছায়ার চেয়েও তা বেশি অদৃশ্য তাই খোলা চোখে দেখা যায় না; আবার প্রতিটি মানুষের সমান্তরাল সত্তা বিদ্যমান কোন অনন্ত প্রান্তে ; যদিও তা তর্ক সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে আমরাÑ ডেজাভু’(উবলধাঁ) প্রসঙ্গে যেতে পারি; যেমন কখনো কখনো আমরা ক্ষণিক অনুভূতিতে কোন ঘটমান ঘটনা কোন একবার কোন এক সময় একইভাবে ঘটেছিল তা অনুভব করি কিন্তু তা আর কোনভাবেই স্মরণ করতে পারি না কোথায় কিভাবে ঘটেছিল। বিজ্ঞান বলে; তাহলে এই ডি জাভু কি আমাদের সমান্তরাল জগতের চিন্তার ছোঁয়া যা এই বাস্তব জগতে হঠাৎ করে অনুভব করি? লালনের গানের প্রথমে আবার ফিরে যেতে হয়Ñ বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা এক পরশি বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’; লালনের এই কথা শুধু গানের কথা থাকে না তা অস্পষ্ট এক অধর জগতের সন্ধানে প্রবৃত্ত করে। এটা কি তাহলে লালনের দিব্য জ্ঞানে সেই প্যারালাল দুনিয়ার ইঙ্গিত? গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বিখ্যাত তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, ম্যাক্স টেগমার্ক, অ্যালান গাথ অনেক সময়ই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এই জগতের বিপরীত এক জগত রয়েছে। এটি চতুর্মাত্রিক জগতের ধারণা; আমাদের পৃথিবীকে আমরা জানতে পারি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা দিয়ে বিধাতা আমাদের দৃষ্টিসীমার যে শক্তি, জ্ঞানের যে ব্যাপ্তি দিয়েছেন তার বাইরে আমরা দেখতে পারি না বা বুঝতে পারি না কারণ আমরা সসীম (ভরহরঃব)। আমরা আমাদের গ্যালাক্সিতে যতগুলো নক্ষত্র দেখি তা দিয়েই; আমাদের জ্ঞানের সীমা দিয়েই মহাবিশ্বের একটা কাঠামো দাঁড় করাই কিন্তু আসলে মহাবিশ্ব অসীম এমন অসীম যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপেও মহাবিশ্বের শেষটুকু দেখা সম্ভব হয়নি। পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র যা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত তাতে আমরা শুধু এই ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বের পরিচয় পাই কিন্তু যদি চতুর্মাত্রিক কোন জগত থেকে থাকে তা আমাদের মানবের ক্ষুদ্র স্বজ্ঞাতে (ওহঃঁরঃরড়হ) ধরা পড়বে না কিন্তু মানুষের রয়েছে কল্পনা করার এক অসাধারণ শক্তি যা বিধাতা দিয়েছেন তাই আমরা দেখি, জানি এবং বুঝতে পারি কিন্তু না জানার তাড়নাই থেকে যায় বেশি। কোয়ান্টাম ম্যাথডের মতে চতুর্মাত্রিক জগতের আকার এমন যা আমাদের জগতের মতো নয় তাই আমাদের পাশেও যদি সে জগত থাকে তা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্য মাত্রা এসে আমাদের তৃতীয় মাত্রায় বিলীন হয়ে গেলেও আমরা জানতে পারব না; কারণ তার মাত্রা আমাদের কাছে পরিমাপযোগ্য নয় তার কিনারা আমরা খুঁজে পাব না। এ এক চরম দুর্বোধ্যতা মানুষের জন্য। মানুষ শুধু বিমূঢ় হয়ে সেই জগতের চিন্তায় মগ্ন-নিমগ্ন হতে পারে- আশ্চর্যের বিষয় লালনকেও সেই আশ্চর্য জগত বিমূঢ় করে দেয়। লালন শুধু একজন গীতিকার আর সুরকারই ছিলেন না, তিনি প্রথম সারির দার্শনিক ও পরিশুদ্ধ শিল্পী তাই দুর্বোধ্যতাকে লালনও খোলাসা করেন না; তার গানে রয়েছে সংকেত আর প্রতীকের শিল্পিত ব্যবহার, লালন তার দুর্বোধ্যতাকে গানের দ্বিতীয় অংশে এভাবে প্রকাশ করেন- গেরাম বেড়ে অগাধ পানি নাই কিনারা নাই তরণী পাড়ে, বাঞ্চা করি দেখবো তারে কেমনে সেথা যাই রে।’ গেরাম বেড়ে অগাধ পানি’ কথাগুলো সংকেতের মাধ্যমে এই মহাজগত সম্পর্কে লালনের বিহ্বলতাকে প্রকাশ করে। লালন জানে সেই জগত থেকেও নেই- আমাদের সীমিত জ্ঞানে তা অনেক বেশি প্রপঞ্চময়- তাই তার আকুতি ভরা প্রশ্ন- কেমনে সেথা যাইরে।’ লালনের চিন্তার অতলভাব আমাদের আরও বিস্মিত করে যখন সে বলে- নাই কিনারা নাই তরণী পাড়ে’ নাই কিনারা শব্দগুলো আমাদের সীমাহীন চতুর্মাত্রিকতায় ডুবিয়ে দেয়; নিয়ে যায় অদর্শনের রাজ্যে। এসটি কোলরিজেরÑ আনসান্ট ম্যারিনার’ যেমন আমাদের কুহকের সমুদ্রে নিয়ে যায় যা পৃথিবীর কোন সরল সূত্র দ্বারা চালিত নয়; পৃথিবীর অনিয়মই যেখানে নিয়ম; অপচ্ছায়ারা যেখানে মানবকে গভীর দ্বিধায় ফেলে দেয় লালনের আরশিনগর গানও আমাদের তেমনি সীমাহীন বিস্ময়ের রহস্যঘেরা এক অরূপ দুনিয়ার সন্ধান দেয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অনেক গানে লালনের মরমীবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলে। রবীন্দ্রনাথও বলেনÑ তোমায় নতুন করে পাব বলে/হারাই ক্ষণে ক্ষণ/ও মোর ভালবাসার ধন/দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন।’ তাই রবীন্দ্রনাথ আবার বলেনÑ সেই অদৃশ্যকে উদ্দেশ্য করে;Ñ তুমি আমার নও আড়ালে/ তুমি আমার চিরকালে/ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন/ও মোর ভালবাসার ধন।’ গানটিতে লালনের মতো মরমী সুর প্রতিধ্বনিত। আবার আরেকটি গানে রবীন্দ্রনাথ অদর্শনের দেখা পেতে উন্মুখÑ তোমার দেখা পাব বলে এসেছি- যে সখা/ কোথা আছ তব লুকায়ে বিজন গৃহে/আবরণ সব দূর করও হে/মোচন করও তিমির জগত/আড়ালে থেক না বিরলে।’ এখানে যেমন আমরা মরমীবাদ পাই, পাই বৈজ্ঞানিক আভাস। সময়কে আমরা আটকাতে পারি না, মাপতে পারি না; বিজ্ঞান বলে তাই আমরা আসল সত্যকেও বুঝতে পারি না। একে রবীন্দ্রনাথ বলেন’ ক্ষণকালের স্রোত’। যদি চতুর্মাত্রিক জগত থেকে থাকে বিজ্ঞান বলে তা আমাদের ঘেরাটোপের এই জগতের মতো নয়; যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায়; তা আমাদের কল্পনা শক্তি, জ্ঞান আর স্বজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে যায় যার পরিমাপ করার মতো ক্ষমতা দিয়ে বিশ্ব-বিধাতা আমাদের পাঠাননি। এটির আকার আলাদা, কাঠামো আলাদা, চেহারা আকৃতি আলাদা তাই আমরা তা চিন্তা করতে পারি কিন্তু প্রমাণের সক্ষমতা আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে নেই। লালন যে দিব্য জ্ঞানের কথা বলে যান সেই দিব্য জ্ঞানের আলোকেই হয়ত আধুনিক বিজ্ঞানের চতুর্মাত্রিক চিন্তা ধারা ধরতে পেরেছিলেন। লালন বিস্ময়ে বিমূঢ় করে বলেন- কী বলবো পড়শির কথা, হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপড় ও সে ক্ষণেক ভাসে নীড়ে।’ হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে’ কথাগুলো আমাদের মধ্যে একটা শিহরণ জাগিয়ে আধা-প্রাকৃতিক, অতিলৌকিক এক মায়াময় রহস্যে ঘেরা জগতের আভাস দেয়। লালনের গানের সঙ্গে বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যে চিন্তা ধারা তা বিস্ময়করভাবে মিলে যায়। হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে’ এক অতিরীন্দ্রিয় রহস্যময় জগত অঙ্কন করে; উত্তরাধুনিক বিজ্ঞান যে প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলে তার সঙ্গে লালনের কথা মিলে যায়। দুটি রেললাইন যেমন সমান্তরাল চলে একে অপরকে ছুঁতে পারে না কখনোই লালনও তেমনি জানেন তিনি বিশ্ব-বিধাতার আংশিক চিহ্ন পাবেন কিন্তু তার মূল পরিচয় কখনো পাবেন না। বিজ্ঞানও তাই বলে এর চধৎধষষবষ টহরাবৎংব বা সমান্তরাল জগত তত্ত্বে। লালনের গানটি শেষ হয় এই না পাওয়ার যন্ত্রণা দিয়ে; যে যন্ত্রণার বাণী তার আরও অনেক গানে প্রতীয়মান। ত্রিমাতৃক আর চতুর্মাত্রিক জগতের মাঝে বিস্তর অমিল; যেমন সময়ে, তেমনি আকারে, গতি পার্থক্যে। আমরা এই পৃথিবীতে এক রূপে বিদ্যমান কিন্তু স্রষ্টা আমাদের আরেক রূপে আমাদের তাঁর কাছে নিয়ে যাবেন; কিন্তু আমরা চেহারা নয় রুহের সেই আকৃতি(সেটা যেমনি হোক) দেখে একে আপরকে চিনতে পারব সেই অনন্ত অসীম রাজ্যে- লালন যেন এর ইঙ্গিত দেন তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গানে- আসবার কালে কী জাত ছিলে/এসে তুমি কী জাত নিলে/কী জাত হবে যাবার কালে/সে কথা ভেবে বলনা।’ এই যে রূপ বদলের প্রপঞ্চ লালন তাও বলে গেছেন তার গানে। লালন তাই মুগ্ধ বিশ্বয়ে কাতর- কে বুঝে তোমার অপার লীলে/আল্লাহ কে বুঝে তোমার অপার লীলে।’ গানটিতে নিরাকার আকারের ইঙ্গিত মেলে নূরে কারে তুমি নূরী/সকারে সৃজন করলে ত্রিভুবন/ সে আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।’ এই পৃথিবীকে মহান আল্লাহ আকার দিয়ে সৃষ্টি করে নিজে নিরাকার হয়ে সর্বব্যাপী বিরাজ করছেন লালন শুধু এটুকুই জানেন আর এটুকু জানেন বলে তিনি আল্লার অপার লীলার আরও ভিন্ন ভিন্ন জগত কাঠামো নিয়ে ভাবতে পারেন। তাই লালন বলেনÑ নিরাকার নিগম ধ্বনি/ সও তো সত্য সবাই জানি।’ আমাদের আকার দিয়ে স্রষ্টা নিজে নিরাকার নিয়ে আছেন এটা তাঁর সুমহান শক্তির পরিচয়। স্্রষ্টার সঙ্গে আকার নিরাকারের যে এই খেলা লালনের জন্য তা বিরাট যাতনার; ক্ষুদ্রাত্মার পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের বাসনা তাই থেকেই যায় পূর্ণ হয় না। লালনের বেদনার ভার দূর হতো যদি সে নিরাকারকে উপলদ্ধি করতে পারত। লালনের মতে এর জন্য বাস্তব জ্ঞান দরকার নয় এর জন্য দিব্য জ্ঞান দরকার। লালন বলেনÑ আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে/দিব্য জ্ঞানী সে হয়েছে।’ কিন্তু দিব্য জ্ঞান যে লালনের পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের আকাক্সক্ষাকে আরও তীব্র করে দেয়; আরও কাতর লালন আরশিনগরে বলেনÑ পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেতো দূরে।’ লালনের জীবনের সকল ব্যথা যে স্রষ্টা তাকে সৃষ্টি করল সে নিজেকে আড়ালে রাখে; জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন অসম্ভব তা শুধু সম্ভব এই জীবনের পরের জীবনে কিন্তু লালনকে পীড়া দেয় কেন সে দিব্য জ্ঞান দিয়ে পরমাত্মার ব্যাপারে জানলো আর কেনই বা পরমাত্মা তার থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গানটি শেষ হয় লালনের সৃষ্ট চতুর্মাত্রিক ধারণা দিয়েÑ সে আর লালন এক খানে রয় তবু লক্ষ যোজন ফাঁকরে।’ দেহ আর আত্মার বিচরণ একখানেই আর আত্মার ভিতরেই গুপ্তভাবে অসীম (ওহভরহরঃব) বিদ্যমান তবুও তা রেললাইনের মতোই সমান্তরাল; প্যারালাল ইউনিভার্স এর মতো যেন। এই ফাঁক কখনো ঘুচবে না কারণ ত্রিমাত্রা আর চতুর্মাত্রা কখনো এক হয় না। যেমন বাউল সাধকরা বলে থাকেন- তেলে জলে মিশ খায় না; কারণ দুটো দুই গুণসম্পন্ন। একদিন এই ব্যবধান ঘুচে যাবে যখন এই দুই গুণ লোপ পেয়ে একগুণে পরিণত হবে। আর মানুষের ক্ষেত্রে তা কেবল মৃত্যুর পরই সম্ভব; আত্মারূপ ধারণ করে। গান বাড়ির কাছে আরশীনগর সেথা একঘর পরশী বসত করে- আমি একদিনও না দেখিলাম তারে। গেরাম বেড়ে অগাধ পানি নাই কিনারা নাই তরণী পাড়ে, বাঞ্ছা করি দেখবো তারে (আমি) কেমনে সেথা যাইরে। কী বলবো পরশীর কথা, হস্ত, পদ, স্কন্ধ, মাথা নাই-রে ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর ক্ষণেক ভাসে নীড়ে। পরশী যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে। সে আর লালন একখানে নয় (তবু) লক্ষ যোজন ফাঁক-রে।
×