মাজেদুল হক
সক্রেটিস বলেছেন- শহড়ি ঃযুংবষভ. একজন কবি, তিনি তাঁর আত্মজীবন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত পরিব্যাপ্তিতে আতস্থ হয়ে মানুষ ও জগতের বিচিত্র বিষয়াদির মধ্যে তাঁর নির্মাণের ঐক্য ধরে রাখেন। এসব চিন্তার অচলায়তন ভেঙ্গে চেতনার সামগ্রিকতাকে রূপ দেন এবং তা হয়ে ওঠে নৈর্ব্যত্তিক ভাষার অনন্ত পরিসর আবার লৌকিকতার মধ্যে বসবাস করেও অলৌকিক চিন্তা-ভাবনা কেবলমাত্র একজন কবিই করতে পারেন। আটপৌরে জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই, অসঙ্গতি, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, নিজস্ব অভিব্যক্তির মধ্যে দুর্গমনীয় চিন্তায় যিনি আবিষ্ট হন তিনিই কবি। কবি জীবননান্দ দাশের ভাষায় কবি সেই যার রয়েছে কল্পনার প্রাচুর্য। তবে সব কবিতা যেমন কবিতা হয় না, তেমনি সবাই কবিও হতে পারে না। কবিতা জীবনের প্রতিবিম্ব। সত্য, সময় ও যুগের কথা বলে। চেতনার প্রসারতার বিপ্লব ঘটায়। কবিতা মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। কবিতার মধ্যে মূল বক্তব্য, শব্দ চয়ন, শব্দের ব্যঞ্জনা, দুর্বোধ্যতা, লেখার কৌশল, পূর্ণাঙ্গ রূপ, শৈলী নির্মাণের ধারা, শৈল্পিক চেতনাবোধের বহিঃপ্রকাশ, জীবনাবেগ ও জীবনদৃষ্টি জাড়িত ভাবনাকে ঘিরে সম্পূর্ণরূপে হয়েছে কি না এসব চিন্তা ভাবনা করে আবেগের লাগাম টেনে ধরে কবিতার ভীত স্থাপন করি।
কবিতার মধ্যে খুঁজে ফিরি কবিতার বৈশিষ্ট্য, কবিতার আত্মার আত্মপরিচয় ও পরাবাস্তব অটোগ্রাফ। কবিতার ভেতর যুক্ত করি উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, রূপকল্প, চিত্রকল্পসহ নানারকম অলঙ্কার। সকল কবিতাপ্রেমীদের মনে রাখতে হবে কবিতা শুধু মনন বিকাশেরই মাধ্যম শুধু নয়, সভ্যতা বিনির্মাণেরও হাঁতিয়ার।
** মানবিক বিপন্নতা
অর্বাচীন সময়ের অষ্টপ্রহরে স্পন্দিত হতে থাকে
ঘূর্ণায়মান কষ্টের মাতম...
নিয়তির মর্মমূলে
আশাতীত ¯œায়ুকোষগুলো
মানবিক বিপন্নতায় মৃত নক্ষত্রের মতো অন্তরীক্ষ
আত্মকেন্দ্রিক মৃত্যুর সিঁড়ি বেয়ে অনুচ্ছ চাঁতালে উঠি ধীরলয়ে
হিংস্র হায়েনার দলগুলো আঁচর কাটে অবলিলায়
বিস্মিত হয়ে তাড়না জপি অথচ আমার কোন নিজস্ব গন্তব্য নেই
নেই কোন চেনা পথ, নেই পারাপারের খেয়া ঘাট
নেই আলো-আঁধারীর আধখানা চাঁদ, নেই কেবল নক্ষত্র
আছে বাঁধ ভাঙা নদী
আছে কান্না ভেজা মেঠো পথ
আছে শুধু ভাঙনের তীব্র বল্লম
আছে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা
আছে রোদেরা মেঘ
আছে বিষণœ দুপুর।
** নষ্ট বিবেকের লেদ মেশিন
নষ্ট বিবেকের আলখাল্লা পড়ে
সময় ও বাস্তবতার সঙ্গে অবিরাম পাল্লা দিয়ে চলছি।
অথচ আচম্বিত ঘূর্ণিপাকে থেমে যাচ্ছে নিজ গতি
বদলে যাচ্ছে আচার-আচরণ, রীতি-নীতি।
বেমালুম সব ভুলে গিয়ে অলৌকিকভাবে
কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ঘুড়ে দাঁড়াই প্রচ- আস্থা ও বিশ্বাসে।
তারপরও অনিষ্টতা আর কষ্টের লেদ মেশিনে জর্জরিত
দ্রাঘিমা রেখা...
রাঙতা পোড়া জীবনের তন্দ্রিতে জমে থাকা প্রবাল ছত্রাক
আর জিঁইয়ে থাকা ভয়ার্ত দানবের অগ্রাসনে
নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে মনুষ্যত্বের ধারা...।
** নীরব দ্রোহের অন্তক্ষরণ
বজ্রপাতের শব্দের মতোই শুনতে পাই
মনের করুণ আর্তনাদ।
নিজ সত্তাকেও হারিয়ে ফেলি অমানিশার ঘনকালো
রাত্রির নির্জনতায়...
প্রলম্বিত কষ্টের তাড়নায় অস্থির হয়ে
ভেজা টলমলে দু’চোখ বুজে প্রশান্তির ব্যর্থ নিঃশ্বাসের
অক্সিজেন নিতে থাকি।
নিঃশ্বাসের ভেতর জিইয়ে থাকা বিষাক্ত ধাতুতে আগুন জ্বললেও
অনিশ্চিত অন্ধকারে ঠেলাগাড়ির মতো কঁকিয়ে কঁকিয়ে
ধীর গতিতে পথচলি...
ছলকে ওঠাÑ অশ্রুমাখা নীল কষ্টের রেণুগুলো এক সময়
যান্ত্রিক জীবনের উত্তাপে দুমড়ে মুচড়ে
ধূলিসাৎ করে দিয়ে যায়...।
** প্রস্তরহীন এপিটাফ
প্রেক্ষাপট পাল্টে যায় জীবনের প্রহর গুণে গুণে;
পাল্টে যায় জীবনের হিসাব-নিকাশ।
যোগ-বিয়োগের গাণিতিক নিয়ম টেনে
রঙ তুলির আঁচড়ে এঁকে যাই জীবন মৃত্যুর প্রচ্ছদ।
দু’দিনের এই শুন্য খেলাঘর ছেড়ে অনিশ্চিত, ধোয়াশাভরা
সীমাহীন অন্ধকারের অতল গর্ভে হারিয়ে যাই
জীবনের ইতি টেনে।
বেদনার বিষাক্ত বিষে স্মৃতির পলেস্তারে লেপ্টে থাকে অবিশ্রান্ত
স্মৃতিমালা, সূরধ্বনি, বহু আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের চিত্ররেখা।
হাজারো অহন কেটে জীবন নাট্যের ঋদ্ধ দলিলে আঁটা
সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার শুদ্ধ সন্ধিক্ষণ
বিবর্ণ, বাকরুদ্ধ, প্রস্তরহীন এপিটাফ...।