ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনায় মাতৃভাষা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনায় মাতৃভাষা

রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতকে অনেকখানিই দখল করেছিল তাঁর শিক্ষা সম্পর্কিত যৌক্তিক আলোচনা। সেখানে প্রাচীনকালের গুরুগৃহের শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে আধুনিককালের ইংরেজী শিক্ষা, সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য নির্দেশনা বিশেষ গুরুত্ব পায়। শৈশব থেকে বাল্যকাল, কিশোর বয়সের পরে যৌবনের যে স্বর্ণ অধ্যায় এবং শেষ অবধি জীবনের বিরাট কাল পর্বে শিক্ষার যথাযথ ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের চেতনার বাস্তবোচিত প্রভাব ফেলে। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল, ইউরোপীয় সংস্কৃতির অবাধ বিস্তার, ইংরেজী ভাষার অযৌক্তিক প্রয়োগে মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা কবিকে ব্যথিত করে, উদ্বিগ্ন করে এবং আপন বৈশিষ্ট্যের নিজস্ব ধারার বিচ্যুতির শঙ্কায় তাকে ভাবিয়েও তোলে। ছোট বয়সে তার নিজের জীবনের শিক্ষার সূচনা কবির জন্য সুখকর কিংবা আনন্দের কোন ব্যাপার ছিল না। গঁৎবাধা জ্ঞানচর্চার বদ্ধ পরিবেশ, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় (১০-৪) পর্যন্ত তার মতে, আন্দামান দ্বীপে আটকে থাকা, জোর করে ইংরেজী ভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা যাকে তিনি মনে করতেন না বুঝে মুখস্থ করা এসব মিলিয়ে তার নিজের বাল্যকালীন বিদ্যালয়ে যাওয়া ছিল এক বিভীষিকাময় দুরবস্থা। ‘জীবন স্মৃতি’তে এসব বিব্রতকর অনুভূতির কথা লিপিবদ্ধ আছে। এমনকি এক মুখস্থ করা কবিতার লাইন ১৯১২ সালে লেখা ‘জীবন স্মৃতিতে’ স্মরণ করছেন। ‘জীবন স্মৃতি’ থেকে কবির উক্তি উদ্ধৃত করছিÑ ‘আমাদের মুখে সেই ইংরেজীটা কি ভাষায় পরিণত হইয়াছিল, তাহার আলোচনা শব্দ তত্ত্ববিদগণের পক্ষে নিঃসন্দেহে মূল্যবান। কেবল একটা লাইন মনে পড়িতেছে কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং মেলালিং মেলালিং অনেক চিন্তা করিয়া ইহার কিয়দংশের মূল উদ্ধার করিতে পারিয়াছিÑ কিন্তু কলোকী কথাটি যে কিসের রূপান্তর তাহা আজও ভাবিয়া পাই নাই। বাকি অংশটা আমার বোধহয়Ñ ঋঁষষ ড়ভ মষবব, ংরহমরহম সবৎৎরষু, সবৎৎরষু, (র. র, নবম খ-, জীবন স্মৃতি, পৃঃ ৪২২)। ইংরেজী সাহিত্যে যে রবীন্দ্রনাথের এত পড়াশোনা, অগাধ পা-িত্য তার যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে অন্যদের কথা বলাইবাহুল্য। ঠাকুরবাড়িতে মাতৃভাষার চর্চা ছিল সবার আগে, কিন্তু ইংরেজী ভাষাকেও সেভাবে অবজ্ঞা কিংবা উপেক্ষা করা হয়নি। বাল্যকালীন এসব স্মৃতি কবিকে এত তাড়িত করে যে বিদ্যাশিক্ষায় মাতৃভাষার কোন বিকল্প নেই এ কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের। ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি দরদ, জানার আগ্রহ ঠাকুরবাড়ীর সমৃদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠা কবির চিরদিনের। বাংলায় লেখা গীতাঞ্জীলকে কবি সযতেœ, আন্তরিক অনুভূতিতে ‘সং অফারিংস’-এ নতুন রূপে, নবসৃষ্টিতে পরিপূর্ণ করেন। ইংরেজী ভাষার রূপান্তর এই ‘সং অফারিংস’ই কবিকে নিয়ে যায় বিশ্ব পরিসরের শ্রেষ্ঠ আসনে। সারা ইউরোপব্যাপী আলোড়ন তোলে কবির এই ইংরেজী লেখা ‘সং অফারিংস’। ‘গীতাঞ্জলী’তে ইংরেজী সাহিত্যের মূল সুর, ভাষা এবং শব্দচয়ন সেভাবে যদি ঝংকৃত না হতো তাহলে ইংরেজ কবি ইয়েটসকে কি অতখানি মুগ্ধ করতে পারত? শুধু কি বিশ্বজয়? সেদিন কবি বাংলা ও বাঙালীকে বিশ্বের দরবারে দাঁড় করিয়েছিলেন, চিনিয়ে দিয়েছিলেন। তার মূল্য তো কোন কিছুর বিনিময়ে হতে পারে না? তাই ইংরেজী ভাষার প্রতি কোন ক্ষোভ কবির কখনই ছিল না। আমরা এও জানি ‘ঞযব পযরষফ’ কাব্যটি প্রথমে ইংরেজফতে লেখা হয়। পরে কবি নিজেই সেটাকে বাংলায় রূপান্তর করেন। কিন্তু শিক্ষার শুরুতে দেশীয় পরিবেশ, নিজের মুখের ভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। এ প্রসঙ্গে ‘শিক্ষা প্রবন্ধে কবির অভিমতÑ ‘একে তো ইংরেজী ভাষা অতিমাত্রায় বিজাতীয় ভাষা। শব্দ বিন্যাস, পদ বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের ভাষার সহিত তাহার কোন প্রকার মিল নাই। তাহার পরে আবার ভাব বিন্যাস এবং বিষয় প্রসঙ্গও বিদেশী। আগাগোড়া কিছুই পরিচিত নহে, সুতরাং ধারণা করিবার পূর্বেই মুখস্থ করিতে হয়। তাহাতে না চিবাইয়া গিলিয়া খাইবার ফল হয় (র. র. ষষ্ঠ খ-, ‘শিক্ষা’, পৃঃ ৪৬৬)।’ এই নাজুক অবস্থা থেকে কবি নিজেই জীবনভর সতর্ক ছিলেন। আমাদেরও এই দুরবস্থার থেকে বের করে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। আর তাই শিক্ষার শুরু থেকে মাতৃভাষাকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। পাশাপাশি বিদেশী ভাষাকে বর্জনের কথাও কখনও বলেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ।’ এর অভাবে শিক্ষা পরিপুষ্টি লাভ করে না, সর্বাঙ্গীণ হয় না সর্বোপরি প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এ শিক্ষা সুফলও বয়ে আনে না। কবির মতে পদ্মা নদীর তীরে বাস করে আমরা যদি টেমস নদীর স্নিগ্ধ জলরাশির অপার সৌন্দর্য অবগাহন করি তাহলে নদীবিধৌত বাংলার নদীই আমাদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। শ্যামল বাংলার নির্মল নৈসর্গিক সৌন্দর্য, নদ-নদীর অববাহিকার প্রাণবন্ত, সজীব ছোঁয়া আমাদের যদি দোলা দিতে না পারে, নিজের ভাষায় সেই রূপকে যদি অনুভব করা না যায় তাহলে আপন দেশের অপার মাধুর্য অধরাই থেকে যাবে। ইংরেজী ভাষা, সাহিত্য আমাদের আনন্দ দেবে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিদেশী ভাবসম্পদ তো নিজের দেশকেই চেনাবে না। ফলে না জানব নিজের দেশ না বুঝব ভিনদেশী পরিবেশ আর সৌন্দর্য। আর তাই শিক্ষা হবে অসম্পূর্ণ, খ-িত এবং প্রায়ই অপ্রয়োজনীয়। ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধে কবির আরও অভিব্যক্তি ‘যখন আমরা একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখি যে, আমরা যেভাবে জীবন নির্বাহ করিব আমাদের শিক্ষা তাহার আনুপাতিক নহে, আমরা যে গৃহে আমৃত্যু বাস করিব সে গৃহের উন্নত চিত্র আমাদের পাঠ্যপুস্তক নহে, যে সমাজের মধ্যে আমাদের জীবনযাপন করিতে হইবে সেই সমাজের কোন উচ্চ আদর্শ আমাদের নতুন শিক্ষিত সাহিত্যের মধ্যে লাভ করি না, আমাদের পিতামাতা, আমাদের সৃহৃদয় বন্ধু, আমাদের ভ্রাতা-ভাগ্নিকে তাহার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি না, আমাদের দৈনিক জীবনের কার্যকলাপ তাহার বর্ণনার মধ্যে স্থান পায় না। আমাদের আকাশ এবং পৃথিবী, আমাদের নির্মল প্রভাত এবং সুন্দর সন্ধ্যা, আমাদের পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত্র এবং দেশলক্ষ্মী স্রোতস্বিনীর কোন সঙ্গীত তাহার মধ্যে ধ্বনিত হয় না, তখন বুঝিতে পারি আমাদের শিক্ষার সহিত আমাদের জীবনের তেমন নিবিড় মিলন হইবার কোন স্বাভাবিক সম্ভাবনা নাই। উভয়ের মাঝখানে একটা ব্যবধান থাকিবেই থাকিবে, আমাদের শিক্ষা আমাদের জীবনের সমস্ত আবশ্যক অভাব পূরণ হতে পারিবে না।’ তাই কবি মনে করতেন শিক্ষার সঙ্গে জীবনের নিবিড় সংযোগই নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দীপ্ত করবে। এ সবের সেতুবন্ধনের প্রধান বাহন মাতৃভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি। এ ক্ষেত্রে বঙ্কিম চন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনের’ যুগান্তকারী ভূমিকায় আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ ভাব এবং ভাষা প্রকাশের এই মাধ্যমটিকে বাঙালীর জীবনবোধ আর প্রবাহের অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার নিজের ভাষায়। ‘বঙ্গদর্শনকে অবলম্বন করিয়া একটি প্রবল প্রতিভা আমাদের ইংরেজী শিক্ষা ও আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যবর্তী ব্যবধান ভাঙিয়া দিয়েছিলÑ বহুকাল পরে প্রাণের সহিত ভাবের একটি আনন্দ সম্মিলন সংঘটন করিয়াছিল, প্রবাসীকে গৃহের মধ্যে আনিয়া আমাদের গৃহকে উৎসবে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছিল।’ নিজের অন্তর্নিহিত বোধ আর ভাবকে মাতৃভাষায় প্রকাশ করার যে পরিপূর্ণতা, অনাবিল আনন্দ আর পরিতৃপ্তির আবেশ তা কখনও ভিন দেশীয় ভাষায় আসতে পারে না। শুধুমাত্র ভাব প্রকাশ কিংবা সাহিত্যচর্চা নয় প্রতিদিনের জীবননির্বাহের আবশ্যিক কর্মের সঙ্গে শিক্ষার যদি গভীরতম সংযোগ তৈরি না হয় তাহলে জ্ঞানার্জনের যথার্থ সুফল কেউ পেতে পারে না। তার নিজের আদর্শিক চেতনা এবং উপলব্ধি থেকেই শান্তিনিকেতনে শিক্ষার যে দ্বার তিনি উন্মোচন করলেন সেখানে সিংহভাগজুড়ে থাকল মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা, আপন প্রকৃতির বেড়াজাল, জীবন ঘনিষ্ঠ পাঠ্যক্রম, স্বদেশীয় ঐতিহ্যিক ধারার সম্মিলন এবং অতি আবশ্যিকভাবে নিজের সঙ্গে দেশকে বোঝার এবং জানার প্রাসঙ্গিক সমস্ত আয়োজন। পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলো বিশ্ব পরিম-লের নতুন জ্ঞান, আধুনিক চিন্তা, বিজ্ঞান চেতনা, সৃষ্টিশীল উদ্যম এবং এরই মধ্যেই নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মাতৃভাষায় যদি বিজ্ঞানচর্চা না হয় তাহলে প্রযুক্তিবিদ্যার সুফল সাধারণ জনগোষ্ঠীর দ্বারে কখনও পৌঁছাবে না। দেশের আপামর জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। গ্রামনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতির পুরো নিয়ন্ত্রক এবং চালিকাশক্তি এই হতদরিদ্র প্রজা সাধারণ। কৃষির পশ্চাৎপদ চাষাবাদ পদ্ধতিতে আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার সমন্বয় ঘটাতে না পারলে পুরো অর্থনীতিতে কোন শুভসূচনা হতে পারে না। নিরক্ষর, মূর্খ, মূঢ় এ দেশে সিংহভাগ মানুষ নিজের ভাষায় বিজ্ঞানকে আয়ত্তে আনতে না পারলে কৃষিতে কখনও নতুন অর্জন আসবে না। তাই কবি বিজ্ঞানকে, সৃজনশীলতাকে, নতুন উদ্ভাবনকে প্রতিটি মানুষের নিত্য কর্মযজ্ঞের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য করার তাগিদ অনুভব করেছেন বার বার। তাই শুধু পুঁথিগত শিক্ষায় নয় ব্যবহারিক প্রাত্যহিক কর্মযোগে ও মাতৃভাষাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করতেন। চীন, রাশিয়া, জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলো ভ্রমণ করে তার এই বদ্ধমূল ধারণা আরও জোরালো হয়। এসব দেশ মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে শুধু শিক্ষাকে নয় প্রকৃতিকে জয় করেছে, বিজ্ঞানকে নিজের আয়ত্তে এনেছে, শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে সর্বোপরি কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের সমস্ত প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছে। ‘জাপান যাত্রী’ প্রবন্ধে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক পত্রে কবি উল্লেখ করেন যে, কিছু দিন আগেও এখনকার সাধারণ জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজ থেকে অনেকখানি পিছিয়ে ছিল, অতি অল্প সময়ের মধ্যে কি করে তারা তাদের সমস্ত কূপম-ূকতা, হীনম্মন্যতা, জড়তা এবং অশুভ সংস্কারকে জয় করে নিজেদের আজকের এতবড় অর্জন আর সম্মানের জায়গায় নিয়ে এসেছে। এসব দেশেও এক সময় প্রকৃতির অন্ধ পূজা ছিল, বংশানুক্রমিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় অসাড়তা ছিল, শক্তিহীনতা, দৌবল্য ছিল। কিন্তু তারা আত্মশক্তিতে জেগে ওঠে, মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে নিজেদেরসহ পুরো দেশের মান্নোন্নয়ন ঘটিয়েছে। শুধু গুটিকয়েক স্বনামধন্য কিংবা শিক্ষিত মানুষের ভূমিকায় এই অসাধ্য সাধন হয়নি। সর্বসাধারণের সার্বিক অংশগ্রহণের সার্থক প্রয়াসের সুফল দেশ ও জাতি মিলিতভাবে ভোগ করছে। আর তাই মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে নিজেকে চেনা, দেশকে ভাবা, উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা, বিজ্ঞানকে কর্মক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা, আর এরই মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যায়, জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক মুক্তি আসে সর্বোপরি ভিতরে ছাইচাপা আগুনের মতো অন্তর্নিহত শক্তি পুরোদমে জ্বলে ওঠে। শিক্ষা মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয়। শিক্ষা সকলের মৌলিক অধিকার এবং সেটা সবাইকে অর্জন করতে হবে। সমৃদ্ধির সর্বক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সফলতা নিয়ে আসা সম্পর্কে কবির ভাবনা যে কত আধুনিক, মাঙ্গলিক এবং বিজ্ঞানসম্মত ছিল তা আজও আমাদের বারে বারে মনে করিয়ে দেয়। তার এই চিন্তা, মনন এখনও যে কত প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য তা সত্যিই বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায়ই শতবর্ষ আগে রবীন্দ্রনাথের যৌক্তিক এই বাণী আজও আমরা সফলভাবে অর্জন করতে পারিনি। গ্রামে-গঞ্জে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আজও যথাযর্থভাবে মাতৃভাষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তো নয়ই। নানাভাবে ভিন দেশী ভাষার চর্চা ও অনুশীলনে নিজের ভাষার মান ঠিক ততটা এগিয়ে যেতে পারছে না। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য আমাদের জন্য সত্যিই একটা মাইলফলক। ফলে স্বাধীনতার যুদ্ধ ও আমাদের বিরাট অর্জন। কিন্তু যে ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য আমরা লড়াই করলাম। এত রক্ত ঝরালাম, লক্ষাধিক প্রাণকে উৎসর্গ করতে হলো সেই ভাষা এবং সংস্কৃতি আজ কোন্ অবস্থানে? আমরা কি সত্যিই মাতৃভাষাকে তার জায়গা দিতে পেরেছি? মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মাতৃভাষা চর্চা আপামর জনগোষ্ঠীর মঙ্গল সাধনে কি যথেষ্ট? দিনের পর দিন মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া যা নিম্নবিত্ত এবং সাধারণ মানুষের জীবন ও কর্মে মাতৃভাষার গুরুত্বকে হালকা করে দিচ্ছে। আর উচ্চবিত্তের জন্য ইংরেজী মাধ্যমে স্কুল-কলেজ তো আছেই। এদের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। উচ্চ শিক্ষায় বিদেশী ভাষা আবশ্যক হলেও শৈশব বাল্যকাল থেকে জীবনের একটা নির্দিষ্ট কাল পর্বে মাতৃভাষার চর্চা অপরিহার্য। তা না হলে নিজ দেশে পরবাসীকে থাকার যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তরও থাকে না। তার ওপর বিদেশী চ্যানেলগুলো আমাদের ভাষা সংস্কৃতিতে যেভাবে বিজাতীয় প্রভাব ফেলছে সেখানেও আমাদের ভাষা হুমকির মুখে পড়ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ চিনে নেয়ার দায় প্রতিটি মানুষের। জ্ঞানী ও গুণী এবং বিজ্ঞজনেরা নির্দেশনা দিতে পারেন, কিন্তু নিজেকে নিজেই রক্ষা করতে হবে। স্বমর্যাদায় বাঁচার পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।
×