ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে ...। বসন্তের বাতাস বইছে এখন। সারাদেশের মতো বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা বরণ করে নিয়েছে প্রিয় ঋতুকে। প্রতিবারের মতোই পহেলা ফাল্গুনে নতুন করে জেগে উঠেছিল রাজধানী। ভালবাসার বিশেষ দিবসটিও সুন্দর কেটেছে। দু’দিনই চমৎকার সেজে বাড়ির বাইরে এসেছিলেন নারীরা। আর নারীরা সেজে বের হলে এই শহর সুন্দর হয়ে যায়। বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বসন্ত আর ভালবাসার দিন অপরূপ হয়ে উঠেছিল রাজধানী। শাড়ি পরতে জানে না মেয়েটি, নিচের দিকে তাকিয়ে সতর্ক হেঁটে গেছে। দেখে অনেকেই মনে মনে বলেছেন, হাট। তুমি এগিয়ে যাও মেয়ে। এই মূর্খ অনুদার মৌলবাদী মানসিকতার উত্থানের কালে তুমি পেছন ফিরে তাকিও না। তোমার পথটি চিনে নাও তুমি। খুঁজে নাও। বুক ভরে নিশ্বাস নাও। তুমি বাঁচো। বসন্ত এবং ভালবাসা দিবসের রেশ কয়েকদিন ধরেই ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। কী আশ্চর্য, সেদিন শুরু হলো মেলা। এখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। করাতের ধনি, হাতুড়ির শব্দ কানে আসছে। অথচ এরই মাঝে অর্ধেকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে এসে বেড়েছে মনোযোগী পাঠকের সংখ্যা। বৃহস্পতিবার মেলা ঘুরে সেটি বেশ বোঝা গেল। একেবারেই অযথা যারা ঘোরা ফেরা করে কাটাতেন, তাদের সংখ্যা কমে এসেছে। সিরিয়াস বইয়ের পাঠকরা তালিকা হাতে নিয়ে বিভিন্ন স্টলে ছুটছেন। জনপ্রিয় ধারার স্টলগুলোর সামনে ভিড় আছে। কিন্তু সিরিয়াস বইয়ের বিক্রি সাদা চোখে দেখা যায় না। একটু খোঁজ নিলে সেটি জানা সম্ভব হয়। উদাহরণ হতে পারে বাংলা একাডেমির প্রকাশনাগুলো। অধিকাংশ বই গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে লেখা। গবেষণাধর্মী। কিন্তু বিপুল বিক্রি। ইউপিএল, মাওলা, সাহিত্য প্রকাশ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, আগামী, প্রথমা, সময়, সুবর্ণ, পাঠক সমাবেশ, অ্যাডর্নসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন বইয়ের জন্য আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। সব ঘুরে দেখা গেছে বইপ্রেমীদের ভিড়। এটি আশার কথা। যত দিন যাবে ভাল বইয়ের বিক্রি তত বাড়বেÑ এমটি আশা করছেন প্রকাশকরা। শিশু প্রহর আজ ॥ শিশুদের জন্য বিশেষ আয়োজন শিশু প্রহর উপলক্ষে আজ শুক্রবার মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়। চলবে যথারীতি রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। বাচ্চাদের নিয়ে মেলায় যারা এখনও যাননি, তাদের জন্য সময় কমে আসছে। আজ শুক্রবার বন্ধের দিনটি তারা কাজে লাগাবেন, আশা করা যায়। ১০২ নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৬তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ১০২টি। উৎস প্রকাশন থেকে মেলায় এসেছে ‘বাঙালির ইতিহাস চর্চার ধারা।’ লিখেছেন নূরুল ইসলাম মনজুর। গ্রন্থটি লেখকের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের পরিমার্জিত রূপ। প্রবাসী লেখক সাংবাদিক মনিজা রহমানের বই ঝর্ণার জলের কারাগার’ প্রকাশ করেছে জাগৃতি। বাংলাদেশ ও নিউইয়র্কের বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত লেখার এটি সংকলন। বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন মনিজা রহমান। তৌহিদুর রহমানের নতুন বই ‘মোনালিসা একটি ছবির নাম।’ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিত্রকর্ম মোনালিসা নিয়ে কতশত কথা। গল্প। পাঁচশ বছর আগে আঁকা ছবি নিয়ে কৌতূহলের শেষ হয়নি আজও। ছোট্ট কিন্তু সমৃদ্ধ বইটি মোনালিসাকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেবে। জ্যোতিপ্রকাশ থেকে আসা বইটি পরিবেশন করছে ম্যাগনামওপাস। সাহিত্য ভবন থেকে মেলায় এসেছে হায়দার বসুনিয়ার উপন্যাস ‘পরমতম বর্গাদাতা।’ জুলফিকার মতিনের উপন্যাস সমগ্র মেলায় এসেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যুক্ত থেকে। বাংলাপ্রকাশ থেকে মেলায় এসেছে রাত্রি রানার কাব্যগ্রন্থ ‘পরিব্রাজক মন।’ মোড়ক উন্মোচন ॥ নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা চলছে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। প্রতিদিনই বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার মোট ২৯টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। একটি বইয়ের কথা আলাদা করে বলা যেতে পারে। গল্প উপন্যাস কবিতা নয়। প্রবাসী শিল্পী সায়ান রায়ের চমৎকার কিছু স্কেচ নিয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রকাশনা। বিজ্ঞাপনী সংস্থা এক্সপ্রেশন থেকে মেলায় আসা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পীরা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আর্ট ক্রিটিক রামেন্দু মজুমদার, কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য, লেখক আনিসুল হক, অভিনয় শিল্পী ত্রপা মজুমদার আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। এ সময় সায়ান রায়, তার সহধর্মিণী ম্যাগানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করে বক্তারা বলেন, বইটির কোন শিরোনাম দেয়া হয়নি। সায়ানের রেখাচিত্র বলা যেতে পারে। ব্ল্যাক লাইনে সুন্দর ড্রইং করেছেন তিনি। কোন বিশেষ বস্তুকে লক্ষ্য করে করা নয়। তার রেখা ও লাইনের প্রকাশ ভঙ্গি আছে। এর সাহায্যে নিজের মনোজগত ও চিন্তার কথা সকলের সঙ্গে শেয়ার করেছেন শিল্পী। বইটি পাওয়া যাবে ‘থিয়েটার’ এর স্টলে। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সত্তর দশকের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি মুজিবুল হক কবীর। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি ইকবাল হাসান এবং ড. খালেদ হোসাইন। সভাপতিত্ব করেন কবি অসীম সাহা। প্রাবন্ধিক বলেন, অজস্র কবির ঋদ্ধ সত্তর দশক। সমকালীন অনুষঙ্গ, প্রসঙ্গ, সঙ্গ ও দর্শন সত্তরের কবিতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন স্বাদ। যুগের অস্তিত্ব, সংকট, প্রগতি, স্ফুরণ, মনোজগৎ ও বহির্জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সত্তরের কবিতায় প্রবলভাবে উপস্থিত। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় চেতনাকে ধারণ করেই সত্তর দশকের কবিরা স্বপ্নময় স্বদেশভূমিকে নিয়ে কবিতা, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার কবিতা, রোমান্টিক ধারার কবিতা, দর্শন ও মিথপুরাণের অনুষঙ্গ নিয়ে কবিতা নানা আঙ্গিকে নির্মাণ করেছেন। আলোচকরা বলেন, বাংলা সাহিত্যের কোন দশকই সত্তরের দশকের মতো এত কবিকে ধারণ করেনি। এ সময়ের কবিরা নির্মাণ করেছেন নিজস্ব একটি কাব্যভাষা যা পঞ্চাশ বা ষাটের দশক থেকে খুবই আলাদা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি আমাদের চারপাশ ঘিরে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় এবং স্বপ্নভঙ্গের যে বেদনা সেটাও প্রতিফলিত হয়েছে সত্তর দশকের কবিতায়। তবে শুধু সংকট নয়, ভবিষ্যত সম্ভাবনার আলোতেও উজ্জ্বল সত্তর দশকের কবিতা। সভাপতির বক্তব্যে কবি অসীম সাহা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমাদের ভেতরে তীব্র আবেগ জেগে উঠেছিল; তারই প্রেরণায় কবিতাজগতেও বিপুল সাড়া জেগেছিল। কিন্তু এই আবেগের তীব্রতা বাস্তবের কষাঘাতে দ্রুতই স্তিমিত হয়ে আসে। তবে এ সময়ের কবিদের মধ্যে অনেকেই বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তি রচনা করেছেন যা আজও আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাইমন জাকারিয়ার পরিচালানায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভাবনগর ফাউন্ডেশন’-এর শিল্পীদের পরিবেশনা। এছাড়া সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী মীনা বড়ুয়া, বুলবুল ইসলাম, ফারহানা ফেরদৌসী তানিয়া, শুভ্রা দেবনাথ, অভিলাষ দাস এবং নিশি কাওসার।
×