ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারীদের উপর জরিপ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারীদের উপর জরিপ

গত বছর অক্টোবর মাস থেকে মিয়ানমারের রাখাইন উপজেলায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরোচিত হামলা চালানো হয় তাতে নারী-পরুষ নির্বিশেষে সহিংস এই ঘটনার শিকার হয়। নারীদের বেলায় এই নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় অনেকখানি। শুধু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে উচ্ছেদ কিংবা দেশছাড়া করা নয়, শারীরিকভাবে পাশবিক নির্যাতনের কোপানলেও পড়তে হয় অসংখ্য নারীকে। যে কোন লোমহর্ষক ঘটনার আনুষঙ্গিক পর্ব হিসেবে যুক্ত হয়ে যায় শারীরিকভাবে দুর্বল নারীদের ওপর অকথ্য নিপীড়নের মতো অমানুষিক ঘটনা। সেখানে কিশোরী থেকে শুরু করে তরুণী, মধ্যবয়স্ক নারীরা কেউই বাদ যায়নি। পৃথিবীব্যাপী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর নিন্দার ঝড় ওঠে। তারপরও এই নৃশংস তা-বলীলার কোন সুরাহা তো হয়ইনি, এর মাত্রাও কমেনি। দেশটির গণতান্ত্রিক সরকার এই নির্মমতার বিরুদ্ধে আজ অবধি কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এর মূল কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিংবা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর উস্কানি এমনকি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এ ধরনের অমানবিক অন্যায় সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে। আর এসবের সমস্ত দায়ভাগ এসে পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। হাজার হাজার উদ্বাস্তু, শরণার্থী দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে এবং তাদের যথাযথভাবে আশ্রয় দেয়ার সমস্ত ব্যবস্থা ও বাংলাদেশকেই করতে হচ্ছে। গৃহচ্যুত এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য এসব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ চোখে দেখা যেসব বীভৎস বর্ণনা দিয়ে গেছে তাতে সভ্যতার সমস্ত শুভশক্তি ধুলায় লণ্ঠিত হচ্ছে। এসব সহিংস ঘটনাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই জঘন্য অপরাদের শাস্তি চেয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ থাকে নির্যাতিত নারী-পরুষের সরাসরি সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে এক জরিপ চালানো হয়। জরিপে ওঠে আসে কি ধরনের মর্মান্তিক দুরাবস্থার পাকে পড়তে হয় অসংখ্য নারীকে। জরিপ মূলত তৈরি করা হয় নির্যাতিতা এবং বেঁচে ফিরে আসা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এবং চলতি জানুয়ারি মাসে ও মিয়ানমারের কয়েকটি গ্রামে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীরা এই সভ্যতা বিবর্জিত তা-ব চালায়। ১৮ জন নিগৃহিত নারী এবং বেঁচে ফিরে আসা কিছু পুরুষের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরিতে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনী ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে যে হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী ঘটনার অবতারণা করে তার জন্য সংস্থাটি অভিযুক্তদের বিচারের দাবি জানিয়েছে। এসব জঘন্য অপরাধে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। নারী জাতির সম্মান, সম্ভ্রম মারাত্মক হুমকির মুখে। জানি না সবধরনের পাশবিকতা কেন নারীজাতির স্বাভাবিক মর্যাদাকে বিপর্যস্ত করে। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে ও ৩০ লাখ মুক্তি সেনার জীবনের বিনিময়ে এমন কী ২ লাখ মা-বোনকেও তাদের সম্ভ্রব পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হয়েছিল। শুধু তাই নয় বিশ্বব্যাপী আইএস জঙ্গীদের যে তা-বলীলা সেখানেও নারী নির্যাতনের ঘটনা এক স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইরাক, ইরান কিংবা তুরস্কের অসংখ্য নির্যাতিত মহিলা অভিবাসী তাদের ওপর ঘটে যাওয়া এসব নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হয়ত বা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নতুবা অজানা কোন আশঙ্কায় কেঁপে ওঠেন। মিয়ানমারের রাখাইনসহ আরও কিছু অঞ্চল থেকে ফিরে আসা নারীরাও তাদের ওপর হওয়া অকথ্য অত্যাচার স্মরণ করতে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। বৌদ্ধ অধ্যুষিত এই ছোট্ট দেশটিতে মুসলিম বিদ্বেষের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও প্রায় ১ লাখ মসুলমান বৌদ্ধদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিপাকে পড়া দেশটির মসুলমান অধিবাসীরা সব সময় অজানা আতঙ্কে তাদের জীবন নির্বাহ করে। নিজ দেশে পরবাসী থাকার মতো যন্ত্রণা প্রতিনিয়তই অনুভব করে। সবচাইতে বিস্ময়ের ব্যাপার অপরাধের মাত্রার সূচনা এমন এক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে আপামর জনগোষ্ঠীর সার্বিক নিরাপত্তা। এ ধরনের বিশৃঙ্খল যদি নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা করে তাহলে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে হিন্দু- মসুলমান-বৌদ্ধ খ্রীস্টান যেই হোক না কেন। যে কোন দেশে একজন নাগরিক তার সমস্ত মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার দাবি রাখে। সেই দাবির উপর আঘাত কিংবা হামলা করা শুধুমাত্র আইনেরই পরিপন্থী নয়- মানবতারও চরম অপমান। আর মিয়ানমার সরকার গত পাঁচ মাস ধরে এ ধরনের গর্হিত অপরাধের কোন বিচারিক প্রক্রিয়াই শুরু করেনি। অন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ কিংবা আরও অনেক রাষ্ট্র কর্তৃক এ ধরনের অপকর্ম ধিক্কৃত হয়েছে, সুষ্ঠু তদন্তের দাবি উঠেছে সর্বোপরি সংশ্লিষ্টদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তিও দাবি করা হয়েছে। সে দেশের নারী ও মানবাধিকার নেত্রী সুচি এবং সরকার এ ব্যাপারে এখনও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি যাতে এ ধরনের বীভৎসতাকে থামানো যায়। দেখা যাক মানবাধিকার সংস্থার এ জরিপ সে দেশের সরকারের টনক নড়ে কিনা কিংবা সংশ্লিষ্টরা একটু হলেও সতর্ক হয় কিনা। নারী নির্যাতনের মতো মর্মান্তিক বিভীষিকার বিরুদ্ধে দেশটির সচেতন জনগণই বা কি ধরনের প্রতিবিধান চায় সেটাও সর্বসমক্ষে আসা বাঞ্ছনীয়।
×