ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

কর্মজীবী নারীরাও অত্যাচারিত

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কর্মজীবী নারীরাও অত্যাচারিত

প্রতিবেশী মিলি আপা। একটি কোম্পানিতে চাকরি করছেন। কাকতালীয়ভাবে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় তার সঙ্গে। কারণ আমরা একই গাড়িতে যাওয়া আসা করি। একদিন দেখলাম মনটা খুব খারাপ। বলল গায়ে ব্যথা করছে। কেন জিজ্ঞেস করতে মনের অজান্তেই কেঁদে ফেলল। তখন যা শুনলাম তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। খুব সাদামাটাভাবে বড় হওয়া একটি সাধারণ মেয়ে ছিল মিলি আপা। বাবা-মায়ের পছন্দেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন লালিত ছিল তা ভাঙতে এক মাসও সময় লাগেনি তার। মাত্র পনেরো দিনের মধ্যেই সে জানতে পারল, যাকে সে সারাজীবনের জন্য বন্ধু ভাবতে চেয়েছিল সে আসলে একজন অর্থপিপাসু। যার উদ্দেশ্য ছিল নিজের স্ত্রীকে ঢাল বানিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে অর্থ উপার্জন। কিছু দিনের মধ্যে মিলি আরও জানতে পারে তার স্বামী অনেক টাকা ঋণী। কিন্তু এত টাকা যোগান দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের কিছু দিন পরে যখন তার বাবার বাড়ির লোকজন কোটিপতির বউ বলে মজা করত তখন সে ঘরের কোনে গিয়ে নীরব কান্না করত। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও স্বামীর সংসার ছাড়ার সাহস তার ছিল না এবং বাবার বাড়িতে বললে তারা কষ্ট পাবে। তাই বোবা কান্নাই ছিল তার সঙ্গী। যে মেয়ের ধ্যান ছিল চুটিয়ে সংসার করার সে আজ তার স্বামী-সন্তান রেখে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরির কারণে বাইরে থাকেন। তার পরও কি শান্তি পেল মিলির জীবন। তার সন্তান পৃথিবীতে আসার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে শুরু হয় তার ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। এরই মধ্যে অজানা অনেক কিছু সে জানতে পারে। যে তার কাছে আদর্শবান একজন ব্যক্তিত্ব থাকবে। তার মাঝে জুয়া নেশা এ রকম অনেক খারাপ অভ্যাস ছিল। কিন্তু এতকিছু জানতে অনেক সময় চলে গেছে। মিলির কাছে পিছু ফেরার পথটা অনেক কঠিন ছিল। বাবার বাড়িতে বিয়ের আগে যে রুমটা বরাদ্দ ছিল তাও আর নেই। কোথায় যাবে সন্তানকে নিয়ে? তাই সে সামনে আগাতে কর্মজীবনে পা দেয়। কিন্তু স্বভাব যে কখনও পরিবর্তন হয় না। বিয়ের আট বছর পেরিয়ে গেছে এবং তারও সন্তান আজ বড় হয়েছে। কিন্তু ওই অমানুষের কোন পরিবর্তন হয়নি। ও কখনও করছে ভালবাসার নাটক কখনও বা শারীরিক নির্যাতন। এত কিছুর পরও নিজে স্বাবলম্বী হয়েও কেন এই নির্যাতন সহ্য করছে মিলি? তার কারণ একটাই- আমাদের সমাজ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হলে বাবার বাড়িতে তার থাকার জায়গাটুকু বিলীন হয়ে যায়। মাও মেয়েকে বোঝা মনে করে। ফলে মেয়েরা আজও অবহেলিত ও নিগৃহীত। এভাবে কিছু কর্মজীবী মেয়েদের সারাদিন পর বাসায় গিয়ে কর্মবিমুখ স্বামীর বিদ্রƒপ আচরণ সহ্য করতে হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মিলির মতো হয়ত আরও অনেক মেয়ে এগুলো নীরবে নিভৃতে সহ্য করছে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজও আমাদের শিহরিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী অধ্যাপিকা ড. রুমানা জাহানের চোখ তুলে নিয়েছিল তার জীবনসঙ্গী হয়ে থাকা এক নরপশু। কর্মজীবী নারীরা স্বাবলম্বী হয়েও এতকিছু সহ্য করছে কারণ তারা আশ্রিতা। আমাদের সমাজে এখনও এমন কোন ব্যবস্থা নেই যেখানে নিগৃহীত নারীরা আশ্রয় পাবে। তাই আমাদের সরকারের উচিত অবহেলিত নারীদের জন্য থাকার সুব্যবস্থা করা। তাহলে হয়ত এসব নরপশু কর্মজীবী ও গৃহিণী উভয় নারীদের শারীরিক নির্যাতন করার আগে ভাবতে হবে। তাদের থাকার জায়গা আছে। তারা আশ্রয়হীন নয়। একই সঙ্গে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে হবে। একটি মেয়ে সংসার ভাঙলেই সে খারাপ হয় না। আমাদের আইনী প্রয়োগ আরও কঠোর করতে হবে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নারীদের সাহস দিতে হবে। অবহেলিত নারীদের আইনের শরণাপন্ন হতে হবে। খুলে দিতে হবে এসব নরপশুর মুখোশ।
×