ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিনেশ মাহাতো

ভাষা আন্দোলনে নারী

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভাষা আন্দোলনে নারী

সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল ছিল মহান ভাষা আন্দোলন। নারী-পুরুষ উভয়ই এতে অংশগ্রহণ করে। বাঙালী এবং বাংলা ভাষা একে অপরের পরিপূরক এবং সহায়ক, তাই বাংলা ভাষাভাষী সকলেই এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সংযুক্ততা তৈরি করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের দাবি বলবৎ ও স্বীকৃতি আদায়ে নারী সমাজের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। শুধু রাজপথের আন্দোলনে নয় সাংগঠনিক কাজেও অবদান রেখেছিল নারীরা। সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। তাছাড়া আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে উদাহরণ সৃষ্টিকারী জাতি হিসেবে বাঙালী জাতি বহু নজির রেখেছে। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ অবধি প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল যুগান্তকারী। আর ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালী জাতির জন্য একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে আসে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখন আন্দোলনটা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন বিভাগীয় এবং জেলা শহরেও নারীদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্কুলের ছাত্রীরাও সে মিছিলে অংশ নিয়েছে। মূল আন্দোলন ঢাকায় হলেও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। ওই সময় বাংলা ভাষার ব্যাপারে বাঙালীদের মধ্যে একটা জাতীয় চেতনা তৈরি হয়েছিল। সেই চেতনা থেকেই উদ্ভূত হয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। শুধু ভাষা আন্দোলন নয় সকল আন্দোলনে নারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া নারীদের প্রায় সবাই মারা গেছেন কয়েকজন ছাড়া। তবে বহুদিন পরে হলেও এ বছর (২০১৭) একুশে পদক পাচ্ছেন অধ্যাপক শরিফা খাতুন ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখার জন্য। তিনি ফেনী মহকুমার শশ্মদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালে। তিনি ১৯৫১ সালে নোয়াখালী সদরের উমা গালর্স হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইডেন থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অনার্স এবং ১৯৫৮ সালে এম এ পাস করেন। ছাত্রী অবস্থাতেই তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আমার মনে হয় এ পদক আরও আগেই তার প্রাপ্য ছিল। ভাষা আন্দোলনে আরও যেসব নারীর কথা আমরা জানি তারা হলেন- যশোরের হামিদা রহমান, বগুড়ার রহিমা খাতুন, সিলেটের হাজেরা, মাহমুদা, যোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, রাবেয়া খাতুনসহ অনেকেই। ময়মনসিংহে ছাত্রী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৫ দিনের জন্য নজরবন্দী হন তাহমিদা সাইদা। ভাষা আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের অন্যতম নারী নেত্রী মমতাজ বেগম গ্রেফতার হলে সারাদেশে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। কুমিল্লার লায়লা নূরের অবদানও ছিল ব্যাপক। সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার পদচারণা অবিস্মরণীয়। লায়লা নূর ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন ১৯৪৮ সাল থেকে বায়ান্নর সব আন্দোলনেই ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। ভাষা সংগামী অধ্যাপক চেমন আরা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে প্রায় ৩৬ বছর তিনি অধ্যাপনা করেন। এ রকম আরও অনেক নারী ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের এ কৃতিত্বের কথা অস্বীকৃতই রয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী এই নারীদের সঠিকভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে এদের অবদানের কথা তুলে ধরা উচিত। কেননা আজ যে ভাষায় আমরা কথা বলি তা অর্জন করতে আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সালাম, জব্বার, রফিক, বরতকসহ আরও অনেকে। এ রকম বহু তাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এ বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, ভাষা ও কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি বাংলা ভাষা ও বাঙালীর জন্য একটি বিরাট সম্মানের বিষয়। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের অনেকে এখনও জানে না যে আমাদের এই মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করেছিল তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকরা। কিন্তু বীর বাঙালী তা রক্ত দিয়ে প্রতিহত করেছে। এই ভাষার মাসে সকল ভাষা সংগ্রামীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নিজ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।
×