ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহদি রপিন

নাট্যকারের রয়্যালটি এবং স্বপ্নদলের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নাট্যকারের রয়্যালটি এবং স্বপ্নদলের উদ্যোগ

‘ভাল কাব্য ভাবুক ছাড়া আর-কাহারো অপেক্ষা করে না। সাহিত্য পাঠ করিবার সময় আমরা সকলেই মনে মনে অভিনয় করিয়া থাকি; সে অভিনয়ে যে কাব্যের সৌন্দর্য্য খোলে না সে কাব্য কোন কবিকে যশস্বী করে নাই। বরঞ্চ এ কথা বলিতে পার যে, অভিনয় বিদ্যা নিতান্ত পরাশ্রিতা। সে অনাথা নাটকের জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া থাকে। নাটকের গৌরব অবলম্বন করিয়াই সে আপনার গৌরব দেখাইতে পারে। স্ত্রৈণ স্বামী যেমন লোকের কাছে উপহাস পায়, নাটক তেমনি যদি অভিনয়ের অপেক্ষা করিয়া আপনাকে নানা দিকে খর্ব করে তবে সেও সেইরূপ উপহাসের যোগ্য হইয়া উঠে। নাটকের ভাবখানা এইরূপ হওয়া উচিত যে, ‘আমার যদি অভিনয় হয় তো হউক, না হয় তো অভিনয়ের পোড়াকপাল আমার কোনই ক্ষতি নাই।’ নাটকের ক্ষেত্রে নাট্যকারের ভূমিকাকে এমনতর মহান রূপে বর্ণনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে তো জানি যে, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনও এক্ষেত্রে অনুরূপ অভিমত পোষণ করতেন। কিন্তু তথাকথিত কতিপয় অর্বাচীন নাট্যনির্দেশক যেন নাট্যকারের সঙ্গে দ্বৈততা প্রকাশকেই স্বীয় কর্তব্য বলে জ্ঞান করেন! কে নাট্যকার থেকে কত দূরবর্তী ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন, পা-ুলিপি থেকে কতটা ভিন্নতর হয়েছেন, কতটা সম্পাদনা-সংশোধন করে পা-ুলিপিকে ‘উদ্ধার’ করেছেন ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে যেন এক বিচিত্র আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। এ অস্বীকারের মাত্রা কখনও এতটাই উচ্চকিত হয় যে তখন এ অবিমৃষ্যকারীদের প্রতি প্রশ্নগুলো যৌক্তিক হয়ে ওঠে-এতটাই যখন নাট্যকারের সৃজনকর্মে আপনার অনীহা, তবে সে অকিঞ্চিতকর নাট্যকারের রচনা সহযোগে আপনার মতো উচ্চাঙ্গের নির্দেশক প্রযোজনা নির্মাণ কর্মে ব্যাপত হলেন কেন এবং অতি অবশ্যই আপনি নিজেই কেন একটি নাটক রচনা করে ‘মানসম্পন্ন’ নাটকের প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের সামনে উপস্থাপন করে আমদের শিক্ষা প্রদান করেন না? উল্লিখিত কথার অর্থ এই নয় যে, পা-ুলিপি চির-অজর বরং তা আবশ্যকতানুয়ায়ী পরিবর্তিত হতেই পারে, তবে তা হতে হবে নির্দেশক-নাট্যকারের যৌথ-মিথস্ক্রিয়ায়। যা হোক ভূমিকাটি করা হলো, এদেশে নাট্যনির্মাণের নানা পর্যায়ে দলের বাইরের ডিজাইনারদের সম্মানী প্রদান স্বাভাবিক প্রচলন হলেও পাশাপাশি বিচিত্র কারণে নাট্যকারকে সম্মান কিংবা সম্মানী প্রদানে অযৌক্তিক অনীহা প্রত্যক্ষ করে। মনে পড়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারার নাটকের বইয়ের শুরুতে মুদ্রিত থাকত- এই নাটকের মঞ্চায়নের পূর্বে নাট্যকারের রয়্যালিটি একশত টাকা প্রদান করতে হবে। অনেক বছর আগে সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ (ফরিদপুর) ছাত্রছাত্রী সংসদে নির্বাচিত নাট্যসম্পাদক থাকাকালীন কলেজের বার্ষিক নাটক ‘তোমরাই’ মঞ্চায়নের পূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে কলেজের পত্রসহ বর্ণিত রয়্যালটি প্রদান করতে গেলে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন গভীর বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, তার এত বছরের নাট্যকার জীবনে আমরাই নাকি প্রথম এমনভাবে রয়্যালটি প্রদান করতে এলাম! আমরা মনে করি, নাট্যকার যদি সঠিকভাবে মূল্যায়নের মাধ্যম প্রণোদিত হন তবেই তার মধ্যে নতুনতর সৃজন-উৎসাহ তৈরি হবে। এদেশেও একদিন থিয়েটার পেশাদার হবে, এ আশাবাদ আমাদের আন্তরিক বিশ্বাসসঞ্জাত। শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ততায় তখনই কেবল নাট্যচর্চায় অভাবনীয় সব নব নব মার্গ উন্মাচিত হতে থাকবে! এ প্রত্যয় বক্ষে ধারণ করে আমাদের নাট্যসংগঠন স্বপ্নদলের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘হেলেন কেলার’ নাটকের নাট্যকার অপূর্ব কুমার কুন্ডুকে দলের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বাংলাদশে শিল্পকলা একাডেমির মহড়াকক্ষে আনুষ্ঠানিক সম্মান ও সম্মানী প্রদান করা হলো। সম্মানীর পরিমাণটা হয়তো কোনভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এতে আমাদের সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা প্রকটভাবেই প্রকাশিত, কিন্তু বিপরীতে আন্তরিকতার পূর্ণপ্রকাশে সামান্যতম ঘাটতি অন্বেষণে আমাদের চিরশত্রুও হয়তো ব্যর্থ হবেন- এ উচ্চারণটা প্রবল আত্মবিশ্বাসেই করতে পারি! থিয়েটার পেশাদার হোক। জয় হোক নাট্যকর্মের।
×