ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গৌতম পাণ্ডে

রুশ নাট্যদলের ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ॥ চেখভ ও গাংচিল

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রুশ নাট্যদলের ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ॥ চেখভ ও গাংচিল

গ্রামাঞ্চলের এক খামারবাড়ির মালিক পিটার সোরিন একজন প্রাক্তন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ইরিনা আর্কাদিনার ভাই। ইরিনা তার প্রেমিক লেখক বরিস ত্রিগোরিনের সঙ্গে অবকাশ যাপন করতে এই খামারবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। দৃশ্যে আবির্ভূত হয় শিক্ষক সিমেন মেদভেদেঙ্কো ও এই খামারবাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়া শামরায়েভের মেয়ে মাশা। মেদভেদেস্কো গোপনে মাশাকে ভালবাসে। কিন্তু এই ভালবাসার কোন জবাব মেলে না মাশার কাছ থেকে। কারণ মাশা ভালবাসে আর্কাদিনার ছেলে কনস্তানতিন ট্রেপলেভকে। মাশাকে বিষন্ন মনে হয় এবং সে ট্রেপলেভ নির্দেশিত নাটকের মঞ্চ পর্যন্ত এলোমেলো করে দিতে চেষ্টা করে। কারণ এই নাটকে তার অভিনয়ের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ট্রেপলেভ ভালবাসে তরুণী নিনা জারেচনায়াকে, সে প্রতিবেশী এক ধনশালী ভূ-স্বামীর মেয়ে। মনে করা হচ্ছে নিনা অভিনয় করবে এই নাটকে। সোরিন এবং তার অতিথিরা কনস্তানতিন ট্রেপলেভ রচিত ও নির্দেশিত একটি নিরীক্ষামূলক নাটক দেখতে খোলা চত্বরে বানানো মঞ্চের ধারে জড়ো হয়েছে। নাটকের ভেতরের এই নাটক নিনাকে তুলে ধরে অনাগত দূরবর্তী ভবিষ্যতের এক পৃথিবীর আত্মা হিসেবে। এই অভিনয় পরিবেশনাটি হলো নতুন নাট্যাঙ্গিক সৃজনের লক্ষ্যে কনস্তানতিনের সর্বশেষ প্রচেষ্টা এবং পরিবেশনাটি একটি গভীর প্রতীকবাদী শিল্পের রূপ লাভ করে। আর্কাদিনা এই নাটকের অভিনয় দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসে। সে একে মনে করে হাস্যকর ও দুর্বোধ্য। শুরু হতে না হতেই নাটক ভেস্তে যায়। কনস্তানতিন অপমানে লজ্জায় দৌড়ে চলে যায়। আর্কাদিনকে মনে হয় সে তার ছেলের ব্যাপারে খুব উদাসীন, তার ছেলে যে একজন নাট্যকার ও নির্দেশক হিসেবে নাট্যজগতে এখনও নিজের পথটি খুঁজে পায়নি সে ব্যাপারে তার ভ্রƒক্ষেপ নেই। কনস্তানতিন গভীর আবেগে অভিমানে প্রদাহে নাটক বন্ধ করে দেয় এবং চলে যায়। মাশাও দৌড়ে যায় তাকে প্রশমিত করতে। এরইমধ্যে আর্কাদিনা নিনাকে ত্রিগোরিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। নিনা বাড়ি যায়। দর্শকরাও পরিবেশস্থল ছেড়ে চলে যায়। যখন অন্যরা সবাই ট্রেপলভের নাটক নিয়ে মশকরা করে তখন একমাত্র ডাক্তার ইয়েভগেনি ডর্ন নাটকটির প্রশংসা করে। ‘চেখভ ও গাংচিল’ নাটকের প্রথম অঙ্কের শেষ হয় এভাবেই। চারটি অঙ্কে বিন্যস্ত বিশ্বখ্যাত রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভ রচিত প্রযোজনাটি একসঙ্গে মঞ্চস্থ হলো তিনটি মঞ্চে। আর এ নাটক নিয়ে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে নাট্যভ্রমণ করল রাশিয়ার নাট্যদল চেখভ স্টুডিও। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার নাট্যদলটি পরিবেশন করে চেখভের নাটক গাংচিল অবলম্বনে নির্মিত প্রযোজনা ‘চেখভ ও গাংচিল’। নাটকের প্রথম অঙ্ক পরিবেশিত হয় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত আঙিনা নন্দন মঞ্চে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্ক মঞ্চস্থ হয় একাডেমির কফি কর্নারে। চতুর্থ অঙ্কটি অভিনীত হয় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে। প্রথম অঙ্কে অনেকগুলো ত্রিভূজ প্রেমের সম্পর্ক প্রকাশ পায়। স্কুলশিক্ষক মেদভেদেঙ্কো ভালবাসে খামারবাড়ির তত্ত্বাবধায়কের মেয়ে মাশাকে। এদিকে মাশা ভালবাসে কনস্তানতিনকে। আবার কনস্তানতিন ভালবাসে নিনা জারেচনায়াকে। কিন্তু নিনা ভালবাসে ত্রিগোরিনকে। পলিন যে ইলিয়া শামরায়েভের স্ত্রী-তার ডাক্তার ডর্নের সঙ্গে প্রেম। কনস্তানতিনের প্রতি মাশার ভালবাসার কথা যখন যে ডর্নকে জানায়, তখন ডর্ন অসহায়ের মতো হ্রদটিকেই দোষারোপ করে প্রত্যেকের মনে প্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য। নাটকটির দ্বিতীয় অঙ্কের ঘটনা ঘটে একটি খেলার মাঠে। কোন এক সময়ে কনস্তানতিন নিনাকে একটি মরা গাংচিল দেখায়, যেটিকে সে একটু আগে গুলি করে মেরেছে। এভাবেই এগোতে থাকে গল্প। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্কের মাঝে কনস্তানতিন মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে কিন্তু গুলি কেবল মাথার খুলি ছুঁয়ে চলে যায়। প্রযোজনায় নির্মিত চতুথ অঙ্কটি চেখভের মূল নাটকে বর্ণিত অঙ্ক থেকে নিশ্চিতভাবে আলাদা। মূল পা-ুলিপিতে তৃতীয় অঙ্কের দুই বছর পর চতুর্থ অঙ্ক শুরু হয়। এই প্রযোজনায় দেখা যায় ১২৯ বছর পর এই অঙ্কের অবতারণা ঘটছে। এই প্রযোজনায় দর্শক আন্তন চেখভ জাদুঘরের মুখোমুখি হয়। নিজেদের আবিষ্কার করে বিভিন্ন প্রদর্শিত দ্রব্যসামগ্রীতে ঠাসা এক কৃত্রিম ভুবনে। যেখানে অভিনেতারাও রয়েছে আর তাদের দেখে মনে হয় তারা জাদুঘরেই কাজ করে এবং এরপর থেকেই তারা স্মৃতি আহরণ করতে শুরু করে যে, একদা এখানেই লেখা হয়েছিল নাটক ‘গাংচিল’। ব্যতিক্রমী এ নাট্য প্রদর্শনী শিল্পরসিকদের মাঝে ছড়িয়েছে মুগ্ধতা। নান্দনিক উপস্থাপনার সঙ্গে সংলাপ ও অনবদ্য অভিনয়ের পরিবেশনায় পড়েছে কয়েক দফা করতালি। নির্মল আনন্দে দর্শকর কাটিয়ে দিয়েছে তিনটি ঘণ্টা। যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস। নাটকে অভিনয় করেছেন নাতালিয়া বেলিয়ায়েভা, পলিনা এলিসিভা, মারিনা সুভোরোভা, তাতিয়ানা ফেদিয়ুশিনা, সার্গেই ফাতিয়ানভ, আইভান কোঝেভনিকভ, ইউরি গলিশেভ, আন্দ্রেই বগদানত, সার্গেই কিরিয়ুশকিন, ভিক্টর রিয়াভব, আলেক্সান্দার গ্রিয়াজনভ, লিওনিদ কাভারগিন, ভদ্মাদিমির সিমোনভ, সার্গেই বিচকভ, বরিস দিরচিকভ ও এলেনা সিমোনভা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আমন্ত্রণ ঢাকায় আসা রাশিয়ার চেখভ স্টুডিও এর পরেরদিন সন্ধ্যায় একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে উপস্থাপন করে আন্তন চেখভের কমেডি নাটক ‘ভল্লুক’।
×