ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশ্যেই কেনাবেচা চলছে সৌদি আরবের ভিসা

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রকাশ্যেই কেনাবেচা চলছে সৌদি আরবের ভিসা

ফিরোজ মান্না ॥ সৌদি আরবের ভিসা কেনাবেচা চলছেই। সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশী দালাল চক্র বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসা কিনে নিচ্ছে। পরে তারা বাংলাদেশে জনশক্তি রফতানিকারকদের কাছে চড়া দামে তা বিক্রি করছে। গুটিকয়েক সৌদি কোম্পানি সরাসরি জনশক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। বেশিরভাগ কোম্পানি দালালদের হাতে ভিসা বিক্রি করছে। এতে সৌদি কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে। ভিসা কেনাবেচার কারণে দেশে বর্তমানে একজন কর্মীকে সৌদি যেতে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। মন্ত্রণালয় থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতিপত্র নিতে গিয়ে জনশক্তি রফতানিকারকরা সরকার নির্ধারিত ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকার কথাই উল্লেখ করছে। এ কারণে কর্মী নিয়োগে বেশি টাকা নেয়ার অভিযোগ থাকলেও মন্ত্রণালয় আইনগতভাবে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৌদি কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পর সৌদি কর্তৃপক্ষ দালাল ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল। কিন্তু কেন-কি কারণে এখনও দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে তা বলতে পারেনি মন্ত্রণালয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানির পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হলেও কর্মীদের কাছ থেকে বেশি টাকার বিষয়টি তারাও জানেন। মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি কর্মীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিচ্ছে কিনা বা এক চাকরির কথা বলে অন্য চাকরিতে দিচ্ছে কিনা এসব বিষয়গুলো ভালভাবে মনিটর করে যাচ্ছে। এর মধ্যেই কর্মীদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা বেশি টাকা নিচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযোগ বিহীন জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানই সৌদিতে কর্মী নিয়োগের সুযোগ পাবে। তারা মন্ত্রণালয় নির্ধারিত খরচের বাইরে বেশি টাকা নিতে পারবে না। যদি কোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশি টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠে, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাতিল হবে জনশক্তি রফতানির লাইসেন্স। সৌদি বাজার উন্মুক্ত হওয়ার সময় উভয় দেশ ভিসা কেনাবেচার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তখন সৌদি কর্তৃপক্ষ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে আশ্বস্ত করেছিল যারা ভিসা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে ১৫ বছরের কারাদ-ের বিধান রেখে আইন করবে। কিন্তু সেই আইন না হওয়ায় ভিসা কেনাবেচা প্রকাশ্যেই হচ্ছে। বাংলাদেশী দালালরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসা সংগ্রহ করে। এই ভিসা বাংলাদেশী জনশক্তি রফতানিকারকরা প্রতিযোগিতা মূলকভাবে কিনছে। এ জন্য কর্মীদের সরকার নির্ধারিত খরচের বাইরে কয়েক গুণ বেশি টাকা নিচ্ছে তারা। অভিযোগ উঠেছে, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানেন। তারা জেনেও কোন ব্যবস্থা নেন না। কারণ এখানে মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তারও স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছে জনশক্তি রফতানিকারকরা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবে কর্মী নিয়োগে সরকার-নির্ধারিত খরচের চেয়ে বেশি টাকা নিলে, সেই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। শুধু লাইসেন্স বাতিলই করা হবে না, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে। দীর্ঘ ছয় বছর পর সম্প্রতি সৌদি আরব সব খাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত করেছে। কোন ধরনের অনিয়মের কারণে বাজার নষ্ট করতে দেয়া হবে না। সরকার যে টাকা নির্ধারণ করেছে, তা যৌক্তিক। সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি টাকা নিলে মন্ত্রণালয় চুপ করে বসে থাকবে না। প্রয়োজনে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আর পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে মন্ত্রণালয়ের কমিটি কাজ করছে। কি করে আরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়, সেটি খেয়াল রাখছে মন্ত্রণালয়। অভিযোগ বিহীন জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানই সৌদিতে কর্মী নিয়োগে কাজ করতে পারবে। জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাড়ে ১২শ’। এখান থেকে ৫ থেকে সাড়ে ৫শ’র প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবে কর্মী পাঠাতে যোগ্য হবে না। কর্মী নিয়োগ স্বচ্ছ করা হয়েছে। এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। সৌদিবাজার খোলার পর গত কয়েক মাসে এক লাখ ২০ হাজার কর্মী নিয়োগ পেয়েছে। কারও কারণে বাজারটি আবার বন্ধ হোক এটা মেনে নেয়া হবে না। সৌদিতে ভিসা কেনাবেচার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করার কাজ করা হচ্ছে। তাদের একটি তালিকা সৌদি কর্তৃপক্ষের হাতে দেয়া হবে। এ বিষয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করা হয়েছে। জনশক্তি রফতানির বিষয়টির নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা এর আগে বলেছেন, সৌদি আরব বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য সব খাত উন্মুক্ত করেছে। এরপর সব পক্ষ মিলে সরকার সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে। ওই বৈঠকে বায়রাকে সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর একটি বাস্তবসম্মত খরচ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছিল। পরে বায়রার কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সব মিলিয়ে জনপ্রতি ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণের প্রস্তাব দেয় মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে খরচ নির্ধারণ করেছে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। কেউ এই টাকার বেশি নিলে বা দাবি করলে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগ্রহী কর্মীদের প্রতিও এর বেশি টাকা না দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হচ্ছে সৌদি আরব। বাজারটি ছয় বছর বন্ধ থাকার পর গত কয়েক মাস ধরে বাজারটিতে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
×