ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনকালে শেখ হাসিনাকে ছুটিতে থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নির্বাচনকালে শেখ হাসিনাকে ছুটিতে থাকতে হবে

শরীফুল ইসলাম ॥ সরকারের সঙ্গে সমঝোতার জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি। দলের কিছু সিনিয়র নেতা ও দলীয় থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত ক’জন বুদ্ধিজীবীর চেষ্টায় রূপরেখা তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। যথাসময়ে এ কাজ শেষ করে দলের সর্বোচ্চ ফেরাম ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে তা তুলে ধরবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ রূপরেখা পাঠিয়ে সংলাপের আহ্বান জানাবেন। সূত্র মতে, বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখার খসড়ায় যা রয়েছে তার মধ্যে ওই সহায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো তিন মাস। নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। তবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে সক্রিয় না থাকেন সে বিষয়টি বিএনপির রূপরেখায় প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এজন্য দলের ভেতর কয়েক ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। একটি প্রস্তাব হচ্ছে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ না করার শর্তে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিন মাসের এই সহায়ক সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। আর আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রপতির অধীন মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দল বিশেষ করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া। এর মাধ্যমে সর্বদলীয় সরকারের আদলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা। এছাড়া নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকে সহায়ক সরকারের প্রধানের বিষয়ে প্রস্তাব করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নির্দলীয় ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা সম্ভব। যার ১০ ভাগ টেকনোক্রেট কোটায় যেমন স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের দিয়ে কাজ করাতে পারবেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশনের মতো নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি রূপরেখা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জাতির সামনে তুলে ধরবেন। এর পর এই রূপরেখাসহ প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়া হবে এ নিয়ে সংলাপের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর সংলাপে রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব। তিনি বলেন, বিএনপি দেশের একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এ দল নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। আর জনগণ যাতে নির্ভয়ে-নিরাপদে তাদের সঠিক রায় দিতে পারে সে জন্যই আমরা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছি। সেই সঙ্গে সরকারকে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করার কথা বলছি। জানা যায়, সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এমনটি ধরে নিয়েই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে। তবে নির্বাচনকালে সরকার যাকে সকল দলের জন্য সহায়ক থাকে এমনটিই আশা করছে বিএনপি। আর এজন্যই বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ নেতাদের পরামর্শ নিচ্ছে বিএনপি। আর ওই রূপরেখার আলোকেই প্রধানমন্ত্রীকে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসার আহ্বান জানাবে। রূপরেখা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের পাশাপাশি এ নিয়ে জনমত তৈরি করতে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে জনতার সম্মুখে এ রূপরেখা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সংবিধান অনুসারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির জন্য নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচনে না গেলে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিএনপিকে বাধ্য হয়েই এ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। আর এ কারণেই দলটি চাচ্ছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হলে আর প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে হয়ত সে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর বিজয়ী হতে না পারলেও সম্মানজনক আসন নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবে। আর এ লক্ষ্য নিয়েই বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করছে। এদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের আগাম প্রস্তাব দিয়ে এবং এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করেও এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সফলতা লাভ করতে পারেনি বিএনপি। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে বিএনপি হতাশ। তবে ৫ জনের মধ্যে অন্তত একজন নির্বাচন কশিনার দলীয় তালিকা থেকে হওয়ায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন কখন কি করে তা জানতে পারবে বিএনপি। আর ইতিমধ্যেই এ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বিএনপি। তবে রাজনৈতিকভাবে এ কমিশনকে চাপে রেখে সুবিধা আদায়ের কৌশল নিচ্ছে। আর এজন্যই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেও এ কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেনি। শীঘ্রই নতুন এই নির্বাচন কশিনের সঙ্গে বৈঠক করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলীয় কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। সূত্র মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়া অন্য কমিশনারদের বিষয়ে তেমন কোন আপত্তি নেই বিএনপির। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপি আমলে চাকরিচ্যুত হওয়া ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ আমলে আবার চাকরি ফিরে পাওয়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবেই বিবেচনা করছে বিএনপি। এ কারণে দলের নেতারা মনে করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়ত বিএনপির প্রতি বিরাগভাজন এবং আওয়ামী লীগের প্রতি সহনশীল থাকতে পারেন। আর এজন্যই নতুন সিইসির ব্যাপারে সমালোচনা অব্যাহত রাখবে বিএনপি। তবে অন্য ৪ কমিশনারের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগের ও আরেকজন বিএনপির তালিকা থেকে মনোনয়ন পাওয়া এবং বাকি ২ জন অন্যান্য ছোট দলের তালিকা থেকে মনোনয়ন পাওয়ায় এবং অতীতে তাদের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ না থাকায় এদের নিয়ে বিএনপি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে তাদের জায়গায় আরও ভাল ভাল লোক নিয়োগ করা যেত বলে কোন কোন বিএনপি নেতা ও ওই দল সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা অভিমত ব্যক্ত করছেন। জানা যায়, নতুন সিইসি কে এম নূরুল হুদার ব্যাপারে ক্ষোভ থাকার কারণেই তাঁকে জনতার মঞ্চের লোক বলে অভিযোগ তুলেছেন। যদিও বিএনপির এ অভিযোগের পর কেএম নূরুল হুদা বলেছেন, জনতার মঞ্চ হয়েছিল ঢাকায় আর তখন তিনি ছিলেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক। কাজেই এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে বিএনপির অভিযোগের পর ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও নতুন সিইসির বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। নতুন সিইসি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেও ২০ দলীয় জোটের কোন কোন শরিক দল তাঁর প্রতি নাখোশ বলে জানা গেছে। তাই সবকিছু মিলিয়ে শুধু বিএনপিই নয় ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও নতুন সিইসির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে যাবে বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি মেনে নিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে বিএনপি। জানা যায়, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখার খসড়ার প্রণয়নের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আরও সংযোজন-বিয়োজন করে তা নিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করবেন খালেদা জিয়া। নেয়া হবে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মতামতও এরপর চূড়ান্ত করা হবে রূপরেখাটি। আর সংবিধানের ভেতর থেকেই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরির কাজ চলছে। সব দলের অংশগ্রহণে কীভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্বব সে বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন না হওয়ায় আমরা হতাশ হয়েছি। তবে আমরা দেখতে চাই এ নির্বাচন কমিশন তাদের কাজে নিরপেক্ষতা রাখতে পারে কি না। আর নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে আমরা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করছি। যথাসময়ে এ রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। আর এ রূপরেখা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানানো হবে। আমরা আশা রাখি প্রধানমন্ত্রী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে করতে একটি সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হবে।
×