ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

গোয়েন্দা গল্পে দারুণ আগ্রহ- সেবার বইয়ে পুরনো স্মৃতি, মুগ্ধতা

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

গোয়েন্দা গল্পে দারুণ আগ্রহ- সেবার বইয়ে পুরনো স্মৃতি, মুগ্ধতা

মোরসালিন মিজান ॥ যা ছিল, তা-ই আছে সেবা। সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনে যে ভিড়, সত্যি দেখার মতো। সেই কবে কোনকালে শুরু করেছিল প্রকাশনা, এখনও হারিয়ে যায়নি। বরং নিজস্বতা নিয়ে চমৎকার টিকে আছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে নতুন পুরনো কত শত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সেবার স্টলটি আলাদাভাবে চোখে পড়ে। না, বিরাট প্যাভিলিয়ন নিয়ে বসেনি। মেলায় উল্লেখ করার মতো জায়গায় স্টল পায়নি এ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পাঠক ঠিকই খুঁজে নিচ্ছেন। মেলা শুরুর পর থেকে শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত এখানে বইপোকাদের ভিড়। প্রতিদিন দেখা দৃশ্যটি মেলার পঞ্চদশতম দিন বুধবার আরও কাছে গিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো। বাম পাশে তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল। ডান পাশে গায়ে গা লেগে আছে একটির। বিপরীত দিকেও বেশ কয়েকটি স্টল। সবগুলো একত্রিত করলে যত পাঠক হবে তার কয়েক গুণ সেবার সামনে দাঁড়িয়ে। দেখে সময় নষ্ট করার কাউকে পাওয়া গেল না। সবাই ক্রেতা। একটি দুটি করে নয়, ব্যাগ ভর্তি করে বই কিনছিলেন। নিউজ প্রিন্টে ছাপা চিরচেনা চেহারার বই। দামেও সস্তা। কিন্তু পাঠ করার অন্য রকম আনন্দ। লক্ষ্য করে দেখা গেল, এখনও সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ‘মাসুদ রানা’য়। ভেবে অবাক হতে হয়, ১৯৬৬ সালে গল্প শুরু হয়েছিল স্পাই মাসুদ রানার। এখনও বিক্রির শীর্ষে। কিশোর-কিশোরীদের বিপুল আগ্রহ ‘তিন গোয়েন্দা’ নিয়ে। রকিব হাসান এই লেখার শুরু করেছিলেন ১৯৮৫ সালের আগস্টে। বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে লেখা গোয়েন্দা সিরিজ দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৬০টি বই লিখেন রকিব হাসান। পরবর্তীতে একই সিরিজের ৫ শতাধিক বই লিখেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব। বিশ্বসাহিত্যের সেরা ক্লাসিকগুলোর কিশোর অনুবাদ, রূপান্তর ও পুনর্লিখন হচ্ছে এখান থেকে। নতুন বইগুলোর মধ্যে বেশি বিক্রি হচ্ছে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের বই ‘মাস্টারমাইন্ড।’ তিন গোয়েন্দা ভলিয়ম ১৪১। যাচ্ছে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ‘কুইন অভ দ্য ডন।’ রূপান্তর করেছেন সায়েম সোলায়মান। আগাথা ক্রিস্টির লেখার অনুবাদ ‘গুপ্তচর’ ভাল বিক্রি হচ্ছে। পি.জি. ওডহাউসের ‘জীভ্স্ অভ অল ট্রেডস’ রূপান্তর করেছেন ডিউক জন। এটিও আগ্রহ নিয়ে কিনছেন পাঠক। স্টলের দায়িত্বে থাকা মমিনুল ইসলাম জানান, সেবা প্রকাশনী থেকে এখন পর্যন্ত বের করা হয়েছে ২ হাজার ৩০০ বই। অর্ধেকের মতো পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানে। এদিন সেবার সামনে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে অনেকগুলো বই কিনেছিলেন সিটি কলেজের শিক্ষার্থী রাজিব। বলল, এই বইগুলো আমাদের বাসায় অনেক আগে থেকেই ছিল। ওগুলো দিয়েই আমার বই পড়া শুরু। একবার ধরলে পড়া শেষ না করে ওঠা যায় না। সেবার স্টলে আসতেই মেলায় আসা বলে জানান আরেক শিক্ষার্থী ইবনুল। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বললেন, গল্পের ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায়। মনে হয়, আমি ওই গল্পের ক্যারেক্টার। সব মিলিয়ে অন্যরকম বৈকি সেবা! নির্বাচিত বই ॥ বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ সংগ্রহ প্রকাশ করছে ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাওলা। সেই ধারাবাহিকতায় মেলায় এসেছে ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ ৪।’ প্রয়াত এই প-িত ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রবন্ধ যোগ হয়েছে চতুর্থ খ-ে। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বের করেছে সেলিনা হোসেনের নতুন বই ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ।’ ২২টি লেখা নিয়ে সংকলন গ্রন্থ। গ্রন্থে বাঙালীর মহান নেতাকে নিয়ে বহুমাত্রিক ভাবনা। বিশ্লেষণ। খুশবন্ত সিংয়ের ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ অনুবাদ করেছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বইটি সম্পর্কে মোটামুটি জানা আছে সবার। নতুন করে প্রকাশ করেছে নালন্দা। কথা প্রকাশ থেকে মেলায় এসেছে ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেনের বই ‘ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধ।’ বইতে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জানা অজানা বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন লেখক। ১৪৩ নতুন বই ॥ মেলার ১৫তম দিনে নতুন এসেছে ১৪৩টি বই। এগুলোর মধ্যে গল্প ১৫, উপন্যাস ২৫, প্রবন্ধ ৭, কবিতা ৫২, গবেষণা ৫, ছড়া ৫, শিশুসাহিত্য ৪, জীবনী ১, মুক্তিযুদ্ধ ২, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ১, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ১, রম্য/ধাঁধা ১, অভিধান ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর লেখা ২০টি বই। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলায় এদিন ৩১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সাংবাদিক- লেখক মামুন মিজানুর রহমানের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘হেসে হেসে ডুবেছিল চাঁদ’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন তাঁর সুহৃদরা। ব্যতিক্রমী চিন্তার তরুণ। সুন্দর লিখেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য। ডা. শাহজাদা সেলিমের ‘ডায়াবেটিসের উপর নজর রাখুন : নিজেকে রক্ষা করুন’ এবং ‘গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও থায়রয়েড হরমোনজনিত সমস্যা ও করণীয়’ বই দু’টির মোড়ক উন্মোচন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সমর সেনের জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান এবং কবি পিয়াস মজিদ। সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। প্রাবন্ধিক বলেন, যে শাহরিক স্তব্ধতা নিঃসঙ্গতা আর মধ্যবিত্তের পলায়নবাদী নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমর সেন কবিতা শুরু করেছিলেন, যে তীক্ষè ব্যঙ্গ আর বিদ্রƒপ ছিল তাঁর লেখনীতে তা দিশা পেয়ে যায় মার্কসীয় প্রত্যয়ে সচেতনতার সরণি বেয়ে। রাতের অন্ধকার আর হলুদ চাঁদের বদলে প্রাণ ডুবে যেতে চায় ফসলের সবুজ বন্যায়। তাঁর জন্মের এই এক শ’ বছর পরেও দেখি মধ্যবিত্ত আরও নিশ্চেতন, ভোগী ও ধূর্ত হয়ে উঠেছে। সবুজ ফসল ভরা ক্ষেতের স্বপ্নাতুর বয়ান আজও মধ্যবিত্তের চেতনায় আলোড়ন তোলে- তাই সমর সেনের কবিতা প্রাসঙ্গিকভাবেই আমাদের সেই ইতিহাসবোধেরই ইমেজিস্ট অন্তর্বয়ন হয়ে ওঠে। সভাপতির বক্তব্যে ভাষা সংগ্রামী ও সুলেখক আহমদ রফিক বলেন, ত্রিশের দশকের শেষ থেকে চল্লিশের দশকে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের যে ধারা বহমান ছিল সমর সেন ছিলেন সে ধারার অন্যতম কবি। ঔপনিবেশিক আমলে কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত সমাজ ছিল কবি সমর সেনের কবিতার উপজীব্য। বাংলা কাব্যসাহিত্যে তিনি নিজের জন্য যেমন একটি স্থায়ী স্থান তৈরি করে গেছেন, তেমনি আমাদের জন্যও রেখে গেছেন অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বহ্নিশিখা’ শিল্পীদের পরিবেশনা।
×