ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের যুদ্ধশিশু ৫

মায়ের খোঁজ না পেয়ে তার দেশকে জানার প্রবল বাসনা বাথলের

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মায়ের খোঁজ না পেয়ে তার দেশকে জানার প্রবল বাসনা বাথলের

রাজন ভট্টচার্য ॥ ‘তোমার জন্ম রক্তের বিনিময়ে, আমার জন্মও রক্তের বিনিময়ে। আমি এক যুদ্ধশিশু, তুমিও এক যুদ্ধশিশু, কারণ আমরা দু’জনেই জানি তোমার-আমার জন্মে রয়েছে অফুরন্ত রক্ত। তুমি সত্যের জন্য উৎকণ্ঠিত হও, আমিও সূত্র জানতে চাই, একসঙ্গে আমরা উজ্জ্বলিত, একসঙ্গে আমরা ভাঙ্গব এসব দেয়াল...’। মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেয়া সকল যুদ্ধশিশুর পক্ষে মায়ের উদ্দেশ্যে নিজের লেখা কবিতায় এভাবেই আবেগ প্রকাশ করেছিলেন বাথল। মাকে খুঁজে পেতে সব চেষ্টা যখন তার ব্যর্থ হয়, তখন আর কিই বা করার থাকে...। হৃদয়ে জন্মধাত্রী মায়ের ছবি ধারণ করে রাখা আর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই একমাত্র ভরসা। এটা সত্যি যে কানাডায় থাকা যুদ্ধশিশুদের মধ্যে মায়ের খোঁজে একমাত্র তিনিই তিনবার বাংলাদেশে এসেছেন। গিয়েছেন সুদূর বরিশালে। ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম-গঞ্জে। পাননি। অবশেষে যান ভারতে থাকা মাদার তেরেসা শিশু সদনের কেন্দ্রীয় দফতরে। সেখানেও মায়ের ঠিকানা সংরক্ষিত রয়েছে এমন কোন নথি পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে যান তিনি। ইচ্ছে ছিল এ দেশে থেকে যাবেন। নাগরিকত্বের সনদও সংগ্রহ করেছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিকসহ নানা বাস্তবতার কারণে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদলে ফিরে যান কানাডায়। জন্মের তিন সপ্তাহ পর বিদেশ যাত্রা ॥ শিশু ভবনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ২৭ জুন মাদার তেরেসা ভবনে ‘বাথল’-এর জন্ম। জন্মের সময় তার ওজন ছিল আড়াই কেজি। তিন সপ্তাহ বয়সে শিশুটিকে কানাডা নিয়ে যাওয়া হয়। অনাথ আশ্রমের লোকজন আদর করে পরিচয়হীন শিশুটির নাম রেখেছিল ‘বাথল’। কারণ জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ করেছিলেন শিশুটির মা। সামাজিক বাস্তবতার কারণে জন্মদাত্রী মা বাথলের জন্মের পর পরই প্রসূতি সদন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। নিজের নাম ঠিকানা কিছুই রেখে যাননি। যুদ্ধের সময় ব্যক্তিগত জীবনের করুণ ইতিহাসও কারও কাছে বলেননি তিনি। তাই হয়তো নীরবে নিভৃতে চলে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, শিশুর পিতৃপরিচয় না থাকায় মা সন্তান নিয়ে স্বামী বা বাবার বাড়ি যাওয়ার আগ্রহ দেখাননি। যুদ্ধ শেষে এসব শিশুর লালন-পালন, আশ্রয় ও পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠা নিয়ে তৎকালীন সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। ঠিক তখন মানবতাবাদী কর্মী ও বিদেশি সংস্থার কর্মকর্তারা যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে এগিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতির এক বিশেষ আদেশের আওতায় সরকার ১৯৭২ সালে আন্তর্দেশীয় শিশু দত্তকায়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় পরিত্যক্ত শিশু ঘোষণা করে যুদ্ধশিশুসহ অন্য শিশুদের পাঠানো হয় বিদেশে। ওই সময় দত্তকায়নে জড়িত ছিল এমন সংস্থাগুলোর একাধিক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কমপক্ষে আড়াই হাজার শিশু বিদেশে পাঠানো হয়েছিল দত্তক হিসেবে। এ-সংক্রান্ত এক তালিকা থেকে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়েছিল ২৩৪ শিশু। নরওয়েতে ২০০ এবং ফ্রান্সে অন্তত ৬০ শিশুকে পাঠানো হয়েছিল। শুরুর দিকে একদিনেই কানাডায় পাঠানো হয়েছিল ১৫ শিশুকে। তাদের একজন বাথল গুড। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ মিশনারি জন হোস্টিংস একাত্তরের জুনে নিউজউইক সাময়িকীকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সেনারা মেয়েদের পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তারপর বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছে তাদের।’ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সীমান্তের ওপারে পেট্রাপোল ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া এক তরুণী টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, ‘দরজা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে কয়েকজন সৈন্য। চোখের সামনে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলে মা আর বাবাকে। মেঝের ওপর ফেলে তিন সেনা মিলে ধর্ষণ করে আমাকে।’ ১৯৭১ সালের ২১ জুন টাইম ম্যাগাজিনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরার এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া আরেক বাঙালী তরুণী টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ১৩ জন পাকিস্তানী সেনা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এভাবে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার স্মারক যুদ্ধশিশুরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র, হাসপাতাল ও বেবি হোম থেকে তখন ‘অনাকাঙ্খিত’ শিশুদের বড় একটি অংশের ঠিকানা হয়েছিল ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির শিশু সদনে। ১৯৭১ সালের ২১ জানুয়ারি মাদার তেরেসা ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঢাকা শাখা স্থাপন করেন। যুদ্ধে যেসব শিশু পরিবার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের একটি অংশও সেখানে আশ্রয় পেয়েছিল। বহু নির্যাতিত নারীও সেখানে সন্তান প্রসব করেন। বেশির ভাগ শিশু সেখান থেকে বিদেশি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দত্তক মা-বাবা পান। যুদ্ধশিশু গবেষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে বিভিন্ন জেলায় ভূমিষ্ঠ যুদ্ধশিশুদেরও পাঠানো হতো। কমপক্ষে ২০ হাজার শিশুকে সেখানে রাখা হয়েছিল। বায়ান থেকে বাথল গুড ॥ বাথলের দত্তক বাবা-মা তার নাম বদলে রাখেন ‘বায়ান গুড’। পুরো নাম ‘বায়ান বাথল গুড’। তিনি বড় হন কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ছোট শহর ক্যাপটাউনে। হ্যাগারসভিল, সাইথপার্ক সেন্টেনিয়েল স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। কার্কটন (১৯৮২-৮৯); সাউথ উিরন ডিস্ট্রিক হাইস্কুলে (১৯৮৬-৯১) পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর তিনি ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরিবেশ ও সম্পদ বিষয়ে অনার্স ডিগ্রী নেন। হাইস্কুলে থাকতেই ১৯৮৯ সালে বায়ান আরও অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে ভ্রমণে আসেন। মাকে পাবার বাসনা ॥ নিজ দেশে আসার বিষয়টি তার জীবনে ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করে। এতে বায়ানের বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের বিষয়ে আরও আগ্রহ তৈরি করে। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশে সফরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী সময়ে বন্ধু ব্রেন্ট জিনজারিক-এর সঙ্গে ফের বাংলাদেশে আসেন তিনি। তখন তার বয়স ১৯। মূলত মায়ের সঙ্গে সাক্ষাত হবে এমন আকাঙ্খা থেকেই তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি চিন্তা করতেন, অন্য সবার মতোই আমার মা সব সময় পাশে থাকবেন। কথা বলবেন। আদর স্নেহ আর মমতা দিয়ে আগলে রাখবেন। তাছাড়া দীর্ঘ সময়ের পর প্রকৃত মাকে খোঁজে পাওয়া মানেই এক ভিন্ন রকম অনুভূতি। যেন মাকে পেলেই হৃদয়ে লালিত বাসনার সমাপ্তি ঘটবে। তাইতো চেষ্টা। হয়তো মায়ের সন্ধান মিলবে। সুতোর টান যেন কোনভাবেই পিছু ছাড়ছিলনা। মমতাময়ী মায়ের হাতের স্পর্ষে হয়তো জীবন ধন্য হবে। তাইতো স্বপ্ন পূরণে দূরন্ত ছুটে চলা তার...। বাবা-মায়ের কাছ থেকে যতটুকু বাংলাদেশ ও তার জন্ম সম্পর্কে তথ্য ছিল এটুকুই ভরসা ছিল তার। বিশ্বাস ছিল এই তথ্যের সূত্র ধরেই জন্মদাত্রী মায়ের কাছে হয়তো পৌঁছানো যাবে। দূর থেকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরবেন মাকে। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলবেন ‘মা’ আমি তোমার সন্তান। যাকে তুমি সামাজিক বাস্তবতার কারণে শিশু সদনে রেখে এসেছিলে। মাকে নিয়ে হাজারো রকমের প্রশ্ন আর পরিকল্পনা মনে আসে। তবে সবকিছু মিলিয়ে এবার মায়ের সন্ধানে বাথল। মায়ের খোঁজ আর পাওয়া গেল না ॥ বাংলাদেশে ফিরে মায়ের খোঁজ পেতে বায়ান যান শিশু ভবনে। সেখানকার কর্মীরা তাকে জানান, তার মায়ের বাড়ি ছিল বরিশালে। সঙ্গে সঙ্গে বায়ান ঠিক করেন যে করেই হোক মায়ের সাক্ষাত পেতে হবে। ছুটে যান বরিশালের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে গেলেন বায়ান। এরপর মায়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য আর কোন তথ্য তার কাছে নেই। বিশাল বড় জেলা। মানুষের কমতি নেই। কোথায় বায়ান তার মাকে পাবেন। তাছাড়া ছেলেকে দেখে মা সামনে এসে দাঁড়াবেন এরকম অলৌকিক ঘটনা ঘটে যাবে তাও নয়। তাহলে উপায়? কোন ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারেননি। তবুও হাল ছেড়ে দেননি। নিজের মতো করে চেষ্টা করেছেন অনেক। সম্ভাব্য অনেকের কাছে গিয়েছেন তিনি। ফলাফল আশাপ্রদ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আশাহত হলেন। কিন্তু স্মৃতি থেকে কল্পনা সরে যায়নি। মাকে পেতে হবে এমন বাসনা মনের মধ্যে যেন স্থায়ী হয়ে শেকড় গেড়েছে। মায়ের খোঁজে ভারতে ॥ অনেক চেষ্টার পর মায়ের দেখা মেলেনি। তারপর বাংলাদেশ থেকে বায়ান ছুটে যান ভারতে। সেখানে কলকাতাস্থ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধান শাখায় যান। সেখানেও মায়ের ব্যাপারে কোন তথ্য পাননি তিনি। সব জায়গা থেকে তার প্রশ্নগুলো ফিরে এলো। উত্তর পাওয়া গেল না। ফের হতাশ বায়ান। তিনি মনে করেন, মাকে খুঁজে পেতে প্রতিষ্ঠিত কোন পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে নেই। এবার মত পরিবর্তন করেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন মায়ের পরিচয় না পেলেও মায়ের দেশ সম্পর্কে জানতে ক্ষতি কি। তখন তিনি ঠিক করেন- তিনি কে? কোথা থেকে এলেন? তার জন্মদাত্রী মা কে ছিলেন; যিনি তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। অনুসন্ধানে বায়ান জানতে পারেন, ১৯৭২ সালে যে ১৫ যুদ্ধ শিশুকে বাংলাদেশ থেকে কানাডা নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে তিনি একজন। ১৫ জনের মধ্যে তিনি একাই তিনবার বাংলাদেশে আসেন। তার তৃতীয় সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ ও দেশের মানুষদের চেনা এবং জানা। তিনি ভাবেন, এ দেশে যত বেশি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করবেন তিনি ততোই বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বেশি জানা যাবে। পালিত বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েই ঢাকা আসতেন তিনি। প্রকৃত মায়ের খোঁজে তার নিরন্তর চেষ্টার সবটুকুই কানাডায় জানাতেন। ঢাকায় থাকা অবস্থায় কানাডীয় বাবা-মায়ের কাছে প্রতিদিনই ই-মেইলে যোগাযোগ হত। লেখক ও গবেষক মুস্তফা চৌধুরীর কাছে কানাডাতে বায়ান জানান, বাবা-মাকে নিয়মিত ই-মেইল করে তথ্য জানানোর কথা। তার বাবা-মা বলেন, ছেলে বায়ানের মেইল পড়ে মনে হতো নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। যেন তারা একই বাড়িতে আছেন। ডাক দিলেই একে অন্যের গলা শুনতে পান। সেই মেইলগুলো এখন পরিবারের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। মেইল পড়তেন আর হাসতেন বাবা-মা দু’জনেই। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন বায়ানের দত্তক পিতা-মাতা। তখনকার সময়ের অভিজ্ঞতার কথাও তিনি লেখকের কাছে বর্ণনা করেছেন। ‘তুমি সত্যের জন্য উৎকণ্ঠিত হও’ ॥ ঢাকায় বারবার আসার সুবাদে বায়ানকে অনুসরণ করতে থাকেন সাংবাদিকরা। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বায়ান যুদ্ধশিশু হিসেবে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন। বহু পত্রিকায় তাকে নিয়ে লেখা হয়। রীতিমতো হইচই পড়ে যায় তাকে নিয়ে। বারবার বাংলাদেশে আসায় এ দেশের রাজনীতি, অনিয়ম, ধর্মচর্চা, দুর্নীতি থেকে শুরু করে সব বিষয়ে তার কিছুটা দখল হয়। যা পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত শেয়ার করতেন। কিন্তু দেশপ্রেম জন্মেছিল এটাও ঠিক। মূল বিষয় ছিল মাকে খোঁজে পাওয়া। এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যোগ দেন তিনি। বাংলাদেশে জন্ম নেয়া সকল যুদ্ধশিশুর কথা ভেবে বায়ান একটি কবিতা লিখেছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে নিজের লেখা কবিতাটি পাঠ করে শোনান। তিনি লিখেন, ‘তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু তুমি আমাকে জানো। আমি তোমাকে চিনি না, কিন্তু আমি তোমার সম্পর্কে জানি। তুমি এখানে এসেছ, যখন এতগুলো বছর ধরে তুমি এসেছ, তোমার জন্ম রক্তের বিনিময়ে, আমার জন্মও রক্তের বিনিময়ে। আমি এক যুদ্ধশিশু, তুমিও এক যুদ্ধশিশু, কারণ আমরা দু’জনেই জানি তোমার আমার জন্মে রয়েছে অফুরন্ত রক্ত। তুমি সত্যের জন্য উৎকণ্ঠিত হও, আমিও সূত্র জানতে চাই, একসঙ্গে আমরা উজ্জ্বলিত, একসঙ্গে আমরা ভাঙ্গব এসব দেয়াল। একসঙ্গে আমরা আমাদের দুঃখ মেটাব, এটাই আমাদের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের কাজ। তোমরা বাংলাদেশের, আমি বাংলাদেশের, আমরা বাংলাদেশের’। এভাবেই বায়ান হৃদয়ে জমে থাকা অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছিলেন কবিতার মাধ্যমে। অপর একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বায়ান বলেছিলেন, ‘যুদ্ধশিশু হওয়ার তাৎপর্যটি আমি বুঝতে পারিনি। যত দিন না আমি ১৮ বা ১৯ বছরে পৌঁছাই। যুদ্ধ সম্পর্কে আমার ধারণা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। যুদ্ধে যেসব ধ্বংসাত্মক কা- ঘটে, সেগুলো সম্পর্কে যখন আমার ধারণা হলো, তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারি যে আমি একজন যুদ্ধশিশু। আমার জন্মধাত্রী মাকে পাকিস্তানী সেনা ধর্ষণ করেছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে ধর্ষণের ফলে আমার জন্ম। এ রুঢ় সত্যটি আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি’। তিনি অনুষ্ঠানে আরও বলেছিলেন, ‘এক ভয়াবহ রক্তস্নানের পর বাংলাদেশ-তোমার আর আমার উত্থান। যারা তাদের জীবন ও জীবিকা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার জন্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই’। বাংলাদেশের প্রতি তার খুব মায়া জন্ম দেয়। তিনি চিন্তা করেন স্থায়ীভাবে দেশটিতে থেকে যাওয়া যায় কিনা। এ রকম হিসাব-নিকাশ থেকেই সরকারের কাছ থেকে নাগরিকত্বের সনদও নিয়েছিলেন তিনি। তার নামের জায়গায় বাথলের পরিবর্তে (বাদল) করে নেন। রেমন্ড প্রভঁশের বিখ্যাত ২০০৩ সালের ডকুমেন্টারি ওয়্যার বেবিজ-এ বায়ান একটি চরিত্র। তিনি মার্টিন নামের ফরাসিভাষী মেয়েকে বিয়ে করেন। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। রয়েছে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। বায়ান অনেকবার নিজের মুখে বলেছেন, তিনি কখনও বাংলাদেশকে ভুলেননি, ভুলতেও পারবেন না। তার বাবা মায়ের নাম ছিল ডরিন ও ডেইল গুড। তারা দু’জনেই কানাডার বাসিন্দা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে তাকে দত্তক নেয়ার পর এই গুড পরিবারেই বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭৬ সালের মে থেকে ১৯৮০ সালের মে মাস পর্যন্ত সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন মীজানুর রহমান শেলী। ২০১৬ সালে সংবাদমাধ্যমকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে যুদ্ধশিশুদের পাঠানো হয়েছিল। পরে তার সঙ্গে অভিভাবকহীন ও পরিত্যক্ত শিশুদের বিদেশে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যুদ্ধশিশুদের পাঠানো শুরু হয় ১৯৭২ সালে। আমার ধারণা, দেড় হাজারের বেশি পরিত্যক্ত শিশুকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, অস্ট্র্র্র্রিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল। শিশুদের দত্তক হিসেবে পাঠানোর পর আমি নেদারল্যান্ডস ও কানাডা সফর করে তাদের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। নেদারল্যান্ডসে ১৪-১৫টি পরিবারে গিয়েছিলাম। বিদেশি ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশীরা মানবিক কারণে শিশুদের দত্তক নিয়েছিলেন। তবে সব নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। আমরা সারাদেশে মাত্র পাঁচ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে কাজ করেছি।’
×