ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এক হাতে গোলাপ অন্য হাতে বই-না, এমন হলো না

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এক হাতে গোলাপ অন্য হাতে বই-না, এমন হলো না

মোরসালিন মিজান ॥ মুঠো ভর্তি গোলাপ। সেই কখন কেনা, কে জানে! হয়ত তাই হাত ভর্তি চুড়ির ওপর নেথিয়ে পড়েছিল। লাল রং রোদে জ্বলে কালচে হয়ে গেছে। তবুও গোলাপ! ভালবাসার বিশেষ দিবসে প্রিয়জনের দেয়া ফুল। কিছুক্ষণ পর পরই নাকের কাছে নিয়ে শুকছিলেন এক তরুণী। এক হাতে গোলাপ। অন্য হাতটি ভালবাসার মানুষের হাতে সঁপে দেয়া। মেলায় প্রবেশ করার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে চমৎকার এই দৃশ্য দেখা। এদের দেখেই হয়ত কবি লিখেছিলেন- নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না...। মেলার ভেতরে প্রবেশের পর এমন আরও অনেক দৃশ্য দেখা গেল। পহেলা ফাল্গুন সোমবার অমর একুশে গ্রন্থমেলা ছিল বাসন্তী রঙের। মঙ্গলবারে এসে দেখা গেল ভালবাসার রং। তরুণ-তরুণীরা নন শুধু, বিভিন্ন বয়সী মানুষ লাল রঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবি গায়ে মেলায় এসেছিলেন। তাদের সূক্ষ্ম আবেগ বুকের কাঁপন অন্য কারও টের পাওয়ার কথা নয়। তবে অনুমান করা গেছে। নিজেদের মধ্যে যে প্রেম ভালবাসাবাসি, বইয়ের জন্যও ছিল। অনেকেই তেমন প্রেমের প্রমাণ রেখেছেন। মজার ব্যাপার হলো, প্রেমিক প্রেমিকাদের উল্লেখযোগ্য অংশটি প্রেম বলতে হুমায়ূন আহমেদকে বুঝে। জনপ্রিয় লেখকের বইয়ের জন্য নামকরা প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে বিকেলে কথা হয় শাহীন ও সুমাইয়ার সঙ্গে। দুজন ঘর বাঁধবেন। সব পাকা হয়ে আছে। শাহীন বললেন, আমাদের মধ্যে মজার সব কা- হয়। সবই হুমায়ূন আহমেদ থেকে শেখা। আসলে উনার (হুমায়ূন) মতো সহজ এবং আবেগী প্রেম আর কারও উপন্যাসে আমি পাইনি। সুমাইয়া যোগ করলেন, হুমায়ূন আহমেদের একই বই আমি চার পাঁচবার পড়েছি। এমন আরও পাঠকের দেখা মিলেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৪তম দিনে। তবে বড় অংশটি যথারীতি ঘুরে বেড়িয়েছে। মোবাইল ফোনে ছবি তুলেছেন সারাদিন। বই নিয়ে তাদের খুব আগ্রহ দেখা যায়নি। এক হাতে গোলাপ আর অন্য হাতে একটি অন্তত বই। হতেই পারত। সন্ধ্যায় মেলা থেকে বের হয়ে আসার সময় আবার দেখা হয়ে গেল গোলাপ হাতের মেয়েটির সঙ্গে। তারাও বেরিয়ে আসছিল। এবং ‘পই পই’ করে খুঁজেও তাদের সঙ্গে কোন বই পাওয়া গেল না! এর কী ব্যাখ্যা? কে বলবে? দুই সপ্তাহে ১৬৩৩ বই ॥ এদিন দুই সপ্তাহ পার করল মেলা। দুই সপ্তাহে মেলায় মোট বই এসেছে ১৬৩৩টি। এগুলোর মধ্যে গল্প ২৩৬টি, উপন্যাস ২৮৮টি, প্রবন্ধ ৮৪টি, কবিতা ৪৭০টি, গবেষণা ২৪টি, ছড়া ৩৯টি, শিশুতোষ ৫১টি, জীবনী ২৫টি, রচনাবলী ৪টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৫১টি, নাটক ১১টি, বিজ্ঞান ২০টি, ভ্রমণ ৩৩টি, ইতিহাস ২১টি, রাজনীতি ৯টি, স্বাস্থ্য ১২টি, কম্পিউটার ৩টি, রম্য ৮টি, ধর্মীয় ৪টি, অনুবাদ ৭টি, অভিধান ১টি, সায়েন্স ফিকশন ২২টি ও অন্যান্য ২১০টি। মেলায় টাস্কফোর্সের অভিযান ॥ মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো পাইরেট বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। নয়টি প্রতিষ্ঠানকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মধ্যে ছিল- হলি পাবলিকেশন, রেজা পাবলিকেশন, শিশুসাহিত্য, বই পড়ি, রাতুল গ্রন্থ প্রকাশ, মেলা, প্রিয়প্রকাশ, পিপিএমসি ও জোনাকী প্রকাশনী। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, শিশুদের কর্নারে বড়দের বই, পাইরেট বই, অননুমোদিত বিদেশী লেখকদের বই এসব স্টল থেকে জব্দ করা হয়েছে। তাদের সতর্ক করে দিয়েছি আমরা। পরবর্তীতে এ কাজ করলে, তাদের স্টল বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানান তিনি। মেলা পরিদর্শনে ডিএমপি কমিশনার ॥ মেলায় দ্বিতীয়বারের মতো পরিদর্শনে আসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, বইয়ের নজরদারির যে কথা উঠেছে সেটা সত্য নয়। নজরদারি করবে বাংলা একাডেমি। তিনি বলেন, বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুলিশ কখনও গ্রন্থমেলার বই নজরদারি করে না। এটা বাংলা একাডেমির কাজ। নির্বাচিত বই ॥ ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের বই ‘ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ঢাকায় থেকে অনেক দেখেছেন এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব। তার দেখার নানা অভিজ্ঞতা বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক রচনা হলেও, গ্রন্থটি ইতিহাসের অনেক সত্যকে ধারণ ও প্রকাশ করেছে। বইটি মেলায় এনেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। রাজনীতিক ও কলামিস্ট ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের প্রবন্ধ সংকলন নির্বাচিত প্রবন্ধ। প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। বইতে বিভিন্ন সময় ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা মোট ২৬টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। অন্যপ্রকাশ থেকে মেলায় এসেছে হো চি মিনের বইয়ের অনুবাদ ‘কারাগারের কাব্য।’ বাংলায় রূপান্তরের কাজ করেছেন মুনীর সিরাজ। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী ভ্যানগগকে নিয়ে লিখেছেন জয়নাল হোসেন। বইয়ের শিরোনামÑ প্রেমিক ভ্যান গঘ ভিনসেন্টের বেদনা-বিলাস ও শিল্পসত্তার গল্প।’ শিরোনাম থেকেই বইটির বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাঠককে আকর্ষণ করার মতো চমকপ্রদ কিছু ঘটনাবলী ও তথ্য নতুন করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ্যাডর্ন থেকে প্রকাশিত বইয়ের দাম ৩৫০ টাকা। আগামী প্রকাশ করেছে মমতাজ লতিফের বই ‘রবীন্দ্র, আমি আর তুমি।’ বইতে রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করে দেখা। এবং লেখা। একটু ব্যতিক্রম তো বটেই। মূল্য ১৫০ টাকা। অবশেষে লেখকদের নামে চত্বর ॥ বহু সমালোচনার পর ত্রয়োদশতম দিনে এসে বাংলা একাডেমির মনে পড়েছে, প্রয়াত লেখক কবি ও বিশিষ্টজনদের স্মরণ করার কথা। এদিন মেলায় প্রবেশ করতেই দেখা যায়, এখানে ওখানে চৌবাচ্চার মতো কাঠের বাক্স। বাক্সের গায়ে ডিজিটাল ব্যানারে প্রয়াত ব্যক্তিত্বদের ছবি। নাম। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কর, দীনেশচন্দ্র সেন, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, নূরজাহান বেগম, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আবদুল গফুর হালী, সরদার জয়েনউদ্্দীন, আমীর হোসেন চৌধুরীর নামে মেলায় চত্বর ঘোষণা করা হয়েছে। ১৪৬ নতুন বই ॥ গ্রন্থমেলার ১৪তম দিনে মঙ্গলবার নতুন বই এসেছে ১৪৬টি। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে এদিন ২৩টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা বইগুলোর মধ্যে দুটি বইয়ের লেখক এ.এস.এম.এ. রায়হান। পেশায় তিনি ডাক্তার। পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বইটির শিরোনাম ‘খাদ্য পুষ্টি পথ্য।’ অন্যটি আবার ‘ভালোবাসি বলেই।’ বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ ও অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘পঞ্চাশ ও ষাট দশকের একুশের সংকলন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক-গবেষক ড. ইসরাইল খান। প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন ও সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত। সভাপতিত্ব করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। প্রাবন্ধিক বলেন, ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে একুশের যেসব সংকলন প্রকাশিত হয় সেগুলো যেন বাংলার নবজাগরণের প্রথম প্রভাতে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের ধারাবাহিকতাকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করে। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রতিষ্ঠাই নিশ্চিত করেনি একই সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে গেছে অসামান্য উত্তাপ। এই উত্তাপেরই ফল হিসেবে আমরা গত শতেকর পঞ্চাশ ও ষাট দশকে অজস্র্র আগুনের ফুলের মতো অসংখ্য একুশের সংকলন প্রকাশিত হতে দেখি। বলাই বাহুল্য এইসব সংকলন কেবল ভাষা আন্দোলন, ভাষাশহীদ এবং অমর একুশের চেতনাকেই ধারণ করেনি, একই সঙ্গে স্বাধীনতামুখী সংগ্রামের বীজও বপন করে গেছে। আলোচকরা বলেন, বায়ান্নর একুশের প্রজন্ম শুধু ভাষা আন্দোলন করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেননি বরং প্রতিকূল পরিবেশে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাড়া-মহল্লায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল সংখ্যক একুশের সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি নিজেদের অকৃত্রিম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁরা বলেন, বাংলা একাডেমি কয়েক দশক আগে একুশের সংকলনের তালিকাভিত্তিক যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল তা হালনাগাদ করে নতুনভাবে প্রকাশিত হলে প্রায় সাত দশকে একুশ কী করে বাঙালী জাতিকে সঞ্জীবিত করেছে তার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাবে। সভাপতির বক্তব্যে কামাল লোহানী বলেন, একুশের চেতনা যেমন একুশের সংকলনের মধ্যে প্রকাশিত তেমনি প্রভাতফেরির মাঝেও মূর্ত হয় কিন্তু দুঃখজনক বিষয় সাম্প্রতিক সময়ে একুশের সংকলন প্রকাশে তরুণদের যেমন উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না তেমনি প্রভাতফেরির রেওয়াজও দুর্লভ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সর্বস্তরের বাংলা ভাষা প্রচলন ও ব্যবহারের রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা পালনের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায় সীমাহীন অবহেলা। তিনি বলেন, ভাষাশহীদের স্মৃতি অমর করে রাখতে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন বাচিক শিল্পী হাসান আরিফ ও তনুশা রহমান। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী খুরশিদ আলম, তপন চৌধুরী, জয় শাহরিয়ার, আফসানা রুনা, অঞ্জলি রায় চৌধুরী এবং আলবেরুনী অণু।
×