ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

শাটলার ঋতুপর্ণার অলিম্পিক স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শাটলার ঋতুপর্ণার অলিম্পিক স্বপ্ন

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদেনীপুরের হলদিয়া। হলদিয়া পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র-বন্দর ও শিল্পনগরী। হুগলি নদী মোহনার কাছে হুগলি ও হলদি নদীর মিলনস্থলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ মিটার উচ্চতায় শহরটি অবস্থিত। কলকাতা শহরের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারি পণ্য আনা-নেয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবেই মূলত হলদিয়া বন্দর-শহরটি গড়ে তোলা হয়। এই শিল্পনগরীতে একাধিক ফ্যাক্টরি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড। এখানেই চাকরি করেন মহানন্দা দাস। তার গৃহিণী স্ত্রী অনন্যা দাস। তাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম সূপর্ণা। তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছোট মেয়ের নাম ঋতুপর্ণা। হলদিয়াতেই জন্ম তার। নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর শক্ত ভক্ত হিসেবে ওর নামও একই রাখা হয়েছে, এমনটা ভাবার কিন্তু কোন কারণ নেই। কিভাবে শাটলার হলেন ঋতু? ‘আমি ছয় বছর বয়স থেকে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু করি। অবশ্য এর ছয় মাস আগে টেবিল টেনিস খেলতাম স্থানীয় একটি ক্লাবের হয়ে।’ টিটি ছেড়ে ব্যাডমিন্টনে কেন? ঋতুর জবাব, ‘টিটিতে আসলে ভাল কোন কোচ ছিল না। ভাল কোচ ছিলেন ব্যাডমিন্টনে। তিনি কলকাতা থেকে হলদিয়ায় যেতেন। ক্লাব কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দেয়। বললোÑ ব্যাডমিন্টন খেললে ভবিষ্যতে হয়তো ভাল কিছু অর্জন করা সম্ভব। তারাও অবশ্য এও বলল, যে কোন একটি খেলা বেছে নিতে। কেননা একসঙ্গে দুই খেলায় ভাল করা সম্ভব নয়, দুই খেলাই বরং খারাপ হবে। বাবা তাই অনেক ভেবেচিন্তে আমাকে ব্যাডমিন্টনই বেছে নিতে বললেন। আর এভাবেই টিটি ছেড়ে ব্যাডমিন্টন খেলায় আসা।’ এ মুহূর্তে বিশে^র ৫৫তম এবং ভারতের তৃতীয় বিডব্লিউএফের (ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন) র‌্যাঙ্কিংধারী নারী শাটলার ঋতু। তার আগে আছেন পুসারালা ভেঙ্কটা সিন্ধুর (৬) এবং সাইনা নেওয়াল (৯)। ঋতুর প্রথম ব্যাডমিন্টন ক্লাব হলদিয়া রিফাইনারি এমপ্লয়িজ ক্লাব। প্রথম কোচ সুরজিৎ সেনগুপ্ত। গত সাত বছর ধরে হায়দরাবাদের বিশ^খ্যাত গোপীচাঁদ একাডেমিতে ট্রেনিং করছেন ঋতু। বাদল ভট্টাচার্য এবং লাল্টু বুডো এই দুই কোচের অধীনে। নিজের দেশে বয়সভিত্তিক ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় প্রচুর সাফল্য আছে ঋতুর। অনুর্ধ-১৩, ১৬, ১৭, ১৯-এর এককে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, সিনিয়র পর্যায়ে রানারআপ (২০১৪ সালে, জাতীয় সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠে শেষ পর্যন্ত বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের তাম্রজয়ী পুসারালা ভেঙ্কটা সিন্ধুর কাছে হেরে যান)। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নিজ দেশের ‘সৈয়দ মোদী ইন্টারন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন চ্যালেঞ্জে’ অংশ নেন ঋতু। প্রথম রাউন্ডে মুর্খার্জী রিয়াকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডেই মুখোমুখি হন বিশ^খ্যাত শাটলারÑ স্বদেশী সাইনা নেওয়ালের। সাইনাও গোপীচাঁদ ব্যাডমিন্টন একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। তবে ঋতুর মুখোমুখি এই প্রথম হন তিনি। বলাইবাহুল্য, অভিজ্ঞ সাইনার কাছে হার মানতে হয় ঋতুকে (২১-১৫, ২১-৯)। ওই বছরেরই জুনে শ্রীলঙ্কা ইন্টারন্যাশনাল চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের সাবরিনা জ্যাকুয়েটের সঙ্গে খেলতে গিয়ে মারাত্মকভাবে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে খেলায় ফিরতে সময় লেগে যায় সাত মাস। এরপর সুস্থ হয়ে এই টুর্নামেন্টের পরেই ঋতু খেলতে আসেন বাংলাদেশে। এবার বাংলাদেশের টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে শিরোপার অনেকটা কাছাকাছিই চলে এসেছিলেন ঋতু। কিন্তু আক্ষেপ জাগিয়ে সেমিফাইনালে হেরে যান ভিয়েতনামের থি ত্রাং ভুর কাছে (১৭-২১, ২১-১৯, ২১-৯ পয়েন্টে, পরে ভু চ্যাম্পিয়ন হন)। প্রথম সেটে জিতেও পরের দুই সেটে দুভার্গ্যরে হার। কারণটা কি? ঋতুর ব্যাখ্যা, ‘প্রথমত প্রতিপক্ষ আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ, রিও অলিম্পিক খেলে এসেছে। দ্বিতীয়ত আমার ফিটনেসের অভাব। কারণ পুরো টুর্নামেন্টেই পায়ে চোট নিয়ে খেলেছিলাম।’ বাংলাদেশ সফরের পর নতুন বছরে একটিই টুর্নামেন্ট খেলেছেন ঋতু। ‘সৈয়দ মোদী ইন্টারন্যাশনাল ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে’ (২৪-২৯ জানুয়ারি) অংশ নিয়ে প্রথম রাউন্ডে নেপালের নাংসাল তামাং এবং দ্বিতীয় রাউন্ডে রাশিয়ার কেসেনিয়া পোলিকারপোভাকে হারালেও কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যান ইন্দোনেশিয়ার ফিত্রিয়ানির কাছে। তবে ২০১৬ সালই তারজন্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল বছর। কেননা বাংলাদেশে আসার আগে তিনি যে ৯টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছিলেন এরমধ্যে ভাল ফল করেন ব্যাক টু ব্যাক টুর্নামেন্টে। একটিতে হন রানারআপ, আরেকটিতে চ্যাম্পিয়ন। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর-১অক্টোবর পর্যন্ত চেকপ্রজাতন্ত্রের প্রাগে অনুষ্ঠিত ‘এফ জেড ফোরজা প্রাগ ওপেনে’ অংশ নেন ঋতু (২৩ দেশের ৮৯ প্রতিযোগী)। ওখানে তিনি বাছাইপর্বে এস্তোনিয়ার ক্যারোলিন হোইমকে, সুইডেনের লোভিসা জোহানন্সসনকে এবং স্লোভাকিয়ার মার্টিনা রেপসিকাকে হারান। নকআউট পর্বের প্রথম রাউন্ডে ডেনমার্কের ইরিনা এমিলি এ্যান্ডারসনকে, দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের সাবরিনা জ্যাকুয়েটকে এবং কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্কের জুলি ফিন্নে ইপসেনকে হারান। সেমিতে হেরে যান একই দেশের নাটালিয়া কচ রঢের কাছে। এর আগের টুর্নামেন্টটাই ছিল ঋতুর স্বপ্নের টুর্নামেন্ট। ২২-২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘ভারকালার পোলিশ ইন্টারন্যাশনালে’ অংশ নেন (২০ দেশের ৬৮ শাটলার)। প্রথম রাউন্ডে ইতালির সারা বয়লিকে, দ্বিতীয় রাউন্ডে ইউক্রেনের তেতিয়ানা পোতাপেঙ্কোকে, কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়ার ইভজেনিয়া কোসেতসকায়াকে, সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের জুলি ম্যাকফারসনকে এবং ফাইনালে স্বদেশী রাসজিকা রাজেকে হারিয়ে জিতে নেন কাক্সিক্ষত শিরোপা। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে খেলার সুযোগ না পেলেও আগামী ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেয়ার স্বপ্ন দেখেন ঋতু। পরিবারের সমর্থন-উৎসাহেই এতদূর আসতে পেরেছেন। খেলতে গেলে স্কুল কামাই হবে, সেজন্য বাবা-মা তাকে উন্মুক্ত স্কুলে পড়িয়েছেন (এখন বি.কম পরীক্ষার্থী, হায়দরাবাদের ওসমানিয়া উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে)। যখন যেখানে দরকার, সেখানে খেলাতে নিয়ে গেছেন (বাংলাদেশেও ঋতু খেলতে আসার সময় ঋতুর সঙ্গে ছিলেন তার বাবা)। বাংলাদেশে এই প্রথম এসে কেমন লেগেছে? ঋতুর সহাস্য উত্তর, ‘এখানকার আবহাওয়া, খাবার, পরিবেশ, মানুষজন সবকিছুই বেশ ভাল লেগেছে। বাঙালী তো, তাই এখানকার বাঙালীদের সবকিছুই দারুণ লাগে।’ খেলার সুবাদে এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে গেছেন ঋতু। বেশিরভাগই আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট। তবে পৃষ্ঠপোষক ছাড়া এ ধরনের টুর্নামেন্টে অংশ নেয়াটা অনেক খরচসাপেক্ষ। এজন্য স্পন্সর খুঁজছেন তিনি। বিকল্প পন্থাও পেয়ে গেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা ওএনজিসিতে (অয়েল ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন) বছর দুই আগে খেলোয়াড়ী কোটায় চাকরি পেয়েছেন। এতে করে খানিকটা হলেও বিদেশ সফর এবং ট্রেনিংয়ের ফিসের টাকাও জোগাতে পারবেন ঋতু। এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনগুলোতে কতটা সাফল্য কুড়িয়ে নিতে পারেন বাঙালী শাটলার ঋতুপর্ণা দাস।
×