ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলোচিত সমালোচিত মুশফিক

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আলোচিত সমালোচিত মুশফিক

ব্যাটসম্যান হিসেবে অপরিহার্যতা বারবারই প্রমাণ করেছেন। তবে ২০১৪ সালে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে। ওই সময় ব্যাট হাতে নিজেও বাজে গেছে মুশফিকুর রহীমের। সে কারণে সে বছর ওয়ানডে ও টি২০ নেতৃত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। কারণটা চাপ কমানো। দলের ব্যাটিংয়ে আস্থার প্রতীক হিসেবে একসঙ্গে উইকেটরক্ষক ও ব্যাটসম্যান হিসেবে আবার দলকে নেতৃত্ব দেয়ার অসহনীয় চাপ থেকে মুক্তির পরও অবশ্য সময় লেগেছে তার। কিন্তু ফিরেছেন ভালভাবেই। দলের জন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন তিন ফরমেটেই। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে একই সঙ্গে নেতৃত্ব আর ব্যাটিং নৈপুণ্যে তিনি অন্যতম নির্ভরতা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেই চলেছেন। ভারতের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। সেই টেস্টে মুশফিক শতক হাঁকিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেছেন। এই সেঞ্চুরির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৩ হাজার রানের মাইলফলকও পেরিয়ে গেছেন। সবমিলিয়ে দেশের বাইরে ৪ সেঞ্চুরি করে এখন মুশফিক সবার ওপরে। আর কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান দেশের বাইরে তিনটির বেশি সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেননি। দেশের জন্য গর্ব বয়ে এনেছেন এভাবে আরেকবার। মুশফিকের ওপর হায়দরাবাদ টেস্টের প্রথম দিন থেকেই অভিযোগের পাহাড়। কারণটা উইকেট রক্ষক হিসেবে এখনও পুরনো ভুলগুলো শুধরে উঠতে পারেননি তিনি। বেশ কয়েকটা সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করার পাশাপাশি সহজ স্টাম্পিং ও রান আউট মিস করেছেন মুশফিক। তাই অভিযোগের আঙ্গুলটা বেশ তীব্র হয়ে ওঠে বাংলাদেশ অধিনায়কের ওপর। হায়দরাবাদের ঐতিহাসিক টেস্টের দু’দিন পর্যন্ত সমালোচনা সইতে হয়েছে তাকে। এমনকি নেতৃত্ব ও উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব ছাড়তে হতে পারে এমন আভাসও দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এতকিছুর পরও ব্যাট হাতে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তিনি। ১০৯ রানে ৪ উইকেট পতনের পর কঠিন বিপর্যয়ে বাংলাদেশ। কারণ ৬৮৭ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ইনিংস ঘোষণা করেছে ভারতীয় দল। আর তখনই সাকিব আল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ১০৭ রানের দুর্দান্ত এক জুটি গড়লেন মুশফিক। সাকিব দুর্দান্ত এক অর্ধশতক হাঁকিয়ে সাজঘরে ফিরে গেলেও মুশফিক হাঁকিয়েছেন সেঞ্চুরি। ভারতের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেস্ট শতক। ইতিহাস সৃষ্টি করেন মুশফিক। নেতৃত্বে আর উইকেটরক্ষণের দায়িত্বে যাই হোক, ব্যাটসম্যান মুশফিক এখনও দেশের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান সেটার নজির আরেকবার দেখালেন। এ কারণেই তাঁকে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ক্যারিয়ারের পঞ্চম টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে তিনি এখন প্রথম বাংলাদেশী যিনি চারটি দেশের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটে শতক হাঁকানোর কৃতিত্ব দেখালেন। সেঞ্চুরিতে যেমন টেস্ট বিশ্বে নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মুশফিক, তেমনি নিজের সীমানা বিস্তৃত করে চলেছেন ব্যাটসম্যানশিপেও। বীরোচিত ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী মেলে ধরেছিলেন আগের দিনই। চতুর্থ দিনটা ছিল কেবল টেনে নেয়ার পালা। দিনের প্রথম ওভারেই হারিয়েছেন আগের দিন লড়াইয়ের সঙ্গী মেহেদী হাসান মিরাজকে। খানিক পর নেই তাইজুল ইসলামও। মুশফিকও নিজের করণীয়টা বুঝে নিলেন। বদলাতে হবে ছুটে চলার গতি। পরের ওভারেই ইশান্ত শর্মাকে পুল করে ছক্কা। উমেশ যাদবকে ফ্লিক করে ইশান্তের মিস ফিল্ডিংয়েই সেঞ্চুরি, ২৩৪ বলে। এ শতক হাঁকিয়ে তিনি ছাড়িয়ে গেলেন চারটি করে সেঞ্চুরি হাঁকানো মুমিনুল হক ও সাকিব আল হাসানকে। মুশফিকের ওপরে এখন মোহাম্মদ আশরাফুল (৬) ও তামিম ইকবাল (৮)। মুশফিক পাঁচটি সেঞ্চুরি করলেন পাঁচটি ভিন্ন দেশে! প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল ভারতের বিপক্ষেই ২০১০ সালে চট্টগ্রামে। এরপর বাংলাদেশকে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়। ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে করেছিলেন আরেকটি সেঞ্চুরি। এবার হায়দরাবাদের এই সেঞ্চুরির আগের টেস্টেই ওয়েলিংটনে অসাধারণ ১৫৯। বাংলাদেশের হয়ে তিনটির বেশি দেশে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানও আর নেই। তামিমের ৮ সেঞ্চুরির ৫টি বাংলাদেশে; ইংল্যান্ডে দুটি, একটি ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আশরাফুলের ৬ সেঞ্চুরির তিনটি দেশে, তিনটি শ্রীলঙ্কায়। সাকিবের চার সেঞ্চুরির দুটি বাংলাদেশে, দুটি নিউজিল্যান্ডে। মুমিনুল হকের চারটিই দেশে। টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করার দিক থেকে বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান মুশফিক। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টানা দুই টেস্টে করেছিলেন তামিম ইকবাল। ২০১৪ সালে আবার টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। মাঝে ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা দুই টেস্টে শতক করেছিলেন মুমিনুল। সেঞ্চুরির পরও থামেননি মুশফিক। অশ্বিনকে টানা দু’ বলে মেরেছেন চার ও ছক্কা। লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন দলকে। শেষ পর্যন্ত শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে অশ্বিনের বলে আউট হয়েছেন ১২৭ রানে। ভারতের হয়ে তিনজন সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। সেসবের মোক্ষম জবাবটা দিয়ে দিলেন মুশফিকও শতক হাঁকিয়ে। কিন্তু এর আগেই ম্যাচের দুই দিনে দলের ফিল্ডিংয়ের সময় মুশফিকের অনেক ভুল সমালোচনার তীরে বিপর্যস্ত করে তাকে। বিরাট কোহলির বিরুদ্ধে একেবারেই ছেলেমানুষিপূর্ণ একটি রিভিউ আবেদন নিয়ে হয়েছে সবচেয়ে বেশি আলোচনা। আর সহজ স্টাম্পিং ও রানআউট মিস করার পাশাপাশি ক্যাচও ছেড়েছেন। এসবই অধিনায়ক হিসেবে চাপের কারণ। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন তাই মুশফিকুর রহীমের টেস্ট নেতৃত্ব ও উইকেটকিপিং নিয়ে কথা বলেছেন। ব্যাটসম্যান মুশফিককে চায় বোর্ড। ব্যাটিংয়ে যাতে প্রভাব না পড়ে এজন্য নেতৃত্ব ও উইকেটকিপিং থেকে সরিয়ে দেয়া হতে পারে তাকে। এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন। হায়দরাবাদ টেস্ট শেষে মুশফিক বোর্ডের ওপরই সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বোর্ড চাইলে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমার টেস্ট ব্যাটিং গড় তো ৩৩ বা ৩৪-এর বেশি না। আমি কিভাবে দলের সেরা ব্যাটসম্যান হতে পারি? আমি যদি দুটি বা তিনটি দায়িত্বে থাকি, তার মানে বোর্ড বা ম্যানেজমেন্ট আমার ওপর আস্থা রাখছে। আমার কর্তব্য তিনটি দায়িত্বই ভালভাবে পালন করা। আমি যদি ভাল করতে না পারি, তাহলে তারা যা মনে করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে আমি তিনটি দায়িত্বই উপভোগ করছি। কারণ, আমি মাঠে থাকতে ভালবাসি। আমার মাঠে সময় কাটানোর উপায় হলো সেখানে দায়িত্ব পালন করা, ড্রেসিংরুমে বসে নয়। আমি আমার সব দায়িত্ব ভালবাসি। তারপরও কিছু হলে সিদ্ধান্ত নেয়ার লোক আছে বাইরে। তবে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাস করলে বলব আমি তিনটিই দারুণ পছন্দ করি। আর নেতৃত্ব আমার হাতে নেই।’ ব্যাটসম্যান মুশফিককেই চায় বিসিবি। নেতৃত্ব ও উইকেটকিপিং থেকে অব্যাহতির ইঙ্গিত দিলেন বিসিবি সভাপতি পাপন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যদি কেউ নেতৃত্ব নিতে রাজি হয়, তাহলেই মুশফিককে অধিনায়ক পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব থেকেও দেয়া হবে অব্যাহতি। পাপন মুশফিকের উইকেটকিপিং নিয়ে জানান, ‘এবার একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হবেই।’ আর মুশফিকের নেতৃত্ব নিয়ে বিসিবি সভাপতি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়টি নিয়েও ভাবছি। গত ৬ মাস ধরেই এ বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। ও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ব্যাটসম্যান। তামিম আর মুশফিক হচ্ছে রেটে সর্বোচ্চ। ও খুব হতাশ। এরই মধ্যে ওর সঙ্গে বসেছি। আলোচনাও করেছি। আসার আগেও বসেছি। এখানে এসেও কথা হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে যদি মুশফিকের পরিবর্তে কোন উইকেটরক্ষক নেয়া হয়, তখন বাদ দেব কাকে? মুশফিককেত বাদ দেয়া যাবে না। বাদ দিলে হয় সাব্বির (রহমান) বাদ পড়বে। অথবা (মাহমুদুল্লাহ) রিয়াদ। আর কোন বিকল্প নেই। সিদ্ধান্ত নেয়া খুব সহজ না। তবে সিদ্ধান্ত দ্রুতই হবে।’ হায়দরাবাদে সেঞ্চুরি হাঁকানোর মাধ্যমে নতুন এক মাইলফলক পেরিয়েছেন মুশফিক। সেই মাইলফলক এর আগে পেরিয়েছেন হাবিবুল বাশারের পর শুধুমাত্র তামিম ইকবাল ও সাকিব। তামিম ৪৭ টেস্টে করেছেন ৩৪৭০ রান আর সাকিব সমান টেস্ট খেলে করেছেন ৩৩১৭ রান। ৩ হাজার রানের ক্লাবে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বশেষ সংযোজন মুশফিক। তার রান এখন ৫২ টেস্টে ৩০৭২। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেস্টে ৩ হাজার রান করেছিলেন হাবিবুল। তিনি ৫০ টেস্টে করেন ৩০২৬ রান।
×