ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অশান্ত হোয়াইট হাউস

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অশান্ত হোয়াইট হাউস

অভিষেক অনুষ্ঠানের রেশ কাটতে না কাটতেই হোয়াইট হাউসকে টালমাটাল করে তুলেছেন নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নীতি-নির্ধারণী কিছু সিদ্ধান্ত ও নির্বাহী আদর্শের আকারে তিনি ছুড়ে মেরেছেন তার মলোটেভ ককটেনগুলো টিপিপি ত্যাগ করেছেন, নাফটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার দাবি জানিয়েছেন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। অভিবাসন নীতিকে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি শীতল নীতি নিয়েছেন। নির্যাতনের সমর্থনে ছড়িয়েছেন এবং সাংবাদিক সমাজের সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে সমালোচকদের চোখে ট্রাম্প যেমন হঠকারী তেমনি পরিস্থিতিকে জগাখিচুড়ি করে তুলতে সিদ্ধহস্ত। তার প্রকৃষ্টতম নজির সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের ৭ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর ঘোষিত সামরিক নিষেধাজ্ঞা। ঘোষণাটি গোপনে অতি তাড়াহুড়ো করে প্রণীত হয়। তবে এর ছাড়া আমেরিকাকে সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনকি রিপাবলিকান মিত্ররাও বিলাপ করে বলেছেন, এই সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশ কার্যকর করার ফলে একটা সুন্দর জনপ্রিয় নীতি পাকচক্রে পড়ে গেল। রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা বিভ্রান্তি সাধারণত ব্যর্থতাই ডেকে আনে। তবে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এই বিশৃঙ্খলা বাহ্যত তার পরিকল্পনারই অংশ। নির্বাচনী প্রচারের সময় তারা যে প্রতিশ্রুতিগুলো অতি বাগাড়ম্বর মনে হয়েছিল সেগুলোই এখন প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক আঘাত হানছে এবং ওয়াশিংটনও গোটা বিশ্বকে কম্পমান করে তুলছে। ট্রাম্পের কারণে আমেরিকা আজ বিভক্ত। এই বিভক্ত আমেরিকায় ট্রাম্পের অপর পক্ষকে শুধু যে ভুল বোঝা হচ্ছে তা নয়, উপরন্তু তাদের বিদ্বেষের পাত্র করা হচ্ছে এবং সেটা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে। কারণ সংঘাত একটা রাজনৈতিক এ্যাসেট বা সম্পদ ভদ্র, নম্র, বিনয়ী জনমতকে আহত করার জন্য ট্রাম্প দ্রুত আক্রমণাত্মক ডাটা ব্যবহার করেছেন ততই তার সমর্থকরা স্থির নিশ্চিত হয়েছে যে তিনি সত্যি সত্যি ওয়াশিংটনের ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুগুলো থেকে বিশ্বাসঘাতক ও লোভী এলিট শ্রেণীকে। তাই তিনি প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ করে প্রায়ই ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে মারছেন। কারণ যতই তিনি ব্রহ্মাস্ত্র মারছেন ততই প্রতিপক্ষের শিবিরে প্রবল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং তার সমর্থক মহল খুশি হচ্ছে। ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে মারার কাজে তার ডানহাত হলেন স্টিফেন ব্যানন ও স্টিফেন মেলোন। তাদের বক্তব্য ও উক্তিতে যতবার বিক্ষোভ হচ্ছে এবং মিডিয়ায় ঝড় উঠছে ততবার ট্রাম্প মহল আশ্বস্ত হচ্ছে যে তিনি ঠিক পথেই চলেছেন। তাদের কাছে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে, মি. ট্রাম্প কাজের মানুষ। তিনি এ্যাকশনে বিশ্বাস করেন যেমন প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। সংঘাতের রাজনীতির মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের একটা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে যেখানে আমেরিকার কয়েক দশকের পররাষ্ট্র নীতি প্রত্যাশাগত। কৌশলগতভাবে ট্রাম্প নিরাপত্তা থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও পরিবেশ পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণকারী বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোর পেছনে সময় ব্যয় করতে প্রস্তুত নন। তিনি বিশ্বাস করেন যে এসব সংস্থায় থেকে আমেরিকার কোন লাভ হয় না। লাভ হয় বা সর্বাধিক সুফল ভোগ করে অন্য দেশগুলো। মাঝখানে আমেরিকাকে খরচের হিসাব গুনতে হয়। তার চাইতে তিনি দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ইস্যুগুলোকে দেখতে চান। এতে আমেরিকার দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ে বৈ কমে না। ব্যানন ও অন্যরাও স্ট্রাটেজিকভাবে আমেরিকার কূটনীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন বহুপক্ষীয়বাদ হলো সেকেলে উদার আন্তর্জাতিক মূর্ত প্রতীক। তাদের মতে আজকের আদর্শিক সংগ্রাম সর্বজীনন মানবাধিকার নিয়ে নয় বরং অন্যান্য সভ্যতার বিশেষত ইসলামের আক্রমণ ও আঘাত থেকে ইহুদী খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিকে রক্ষার সংগ্রাম। তাদের এই দৃষ্টিকোণ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হলো পথের কাঁটা এবং ভøাদিমির পুতিন এই মুহূর্তের জন্য সম্ভাবনাময় মিত্র। এই বিষয়গুলো ট্রাম্প কত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন কেউ জানে না। সম্ভবত ক্ষমতার অসংখ্য ফাঁদের মধ্যে থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে চালাতে ট্রাম্প ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। সম্ভবত শেয়ার বাজারের দর সংশোধনীর ফলে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি হবে যে তিনি মি. ব্যাননকে বাদ দিয়ে দেবেন। সম্ভবত সঙ্কটের মুখে তিনি সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ধরা দেবেন। তবে এমনটা যে শীঘ্রই ঘটবে তা মনে করার কোন কারণ নেই। আমেরিকানরা যারা ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ট্রাম্প আমেরিকার কতটা কি ক্ষতি করতে পারেন। তাদের এমন আশঙ্কার সঙ্গত ভিত্তি আছে। তবে দেশের প্রচলিত আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের রক্ষা করার জন্য আছে। অবশ্য সার্বিকভাবে দেখলে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভারসাম্যের ব্যবস্থা আছে সামান্যই এবং সে জন্যই পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। আমেরিকার সক্রিয় সমর্থন ও অংশীদারিত্ব ছাড়া বৈশ্বিক সহযোগিতার ব্যবস্থাবলী ব্যর্থ হয়ে যাবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার নামের যোগ্যতাটি হারিয়ে ফেলবে। জাতিসংঘেরও কার্যকারিতা হারিয়ে যাবে। অসংখ্য চুক্তি ও কনভেনশন ক্ষুণœ হবে। প্রতিটি চুক্তি এককভাবে স্বতন্ত্র হলে সামগ্রিকভাবে সেগুলো একটা ব্যবস্থায় পরিণত হয়ে আমেরিকাকে তার মিত্রদের সঙ্গে আবদ্ধ রেখেছে এবং বিশ্বজুড়ে তার ক্ষমতাকে জাহির করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এসব চুক্তি থেকে সরে এলে আমেরিকার ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। আমেরিকা তখন বিপর্যয়ে পড়বে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×