ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা কানাডার আদালতে খারিজ

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা কানাডার আদালতে খারিজ

৯ ফেব্রুয়ারি অন্টারিও সুপেরিয়র কোর্টের বিচারপতি ইয়ান নরধেইমার তিনজন ব্যবসা কার্যনির্বাহিকদের এসএনসি-লাভালিন গ্রুপ ইনকর্পোরেটেড দুর্নীতি, যেটা পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত, সে মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন এবং মামলাটিকে খারিজ করে দিয়েছেন। বিচারকের মতে বিচারক ক্ষেত্রে যে রিৎবঃধঢ় প্রমাণ দাখিল করা হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ গুজবের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। অন্টারিও সুপেরিয়র কোর্টের বিচারপতি ইয়ান নরধেইমার তার রুলিং এ বলেন- ২০১১ সালে জঈগচ, কানাডিয়ান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অত্যন্ত স্বতন্ত্র এবং সম্মানিত অঙ্গ, ২০১১ সালে দায়ের করা একটা আবেদনে রিৎবঃধঢ় ব্যবহার করতে আদালতের অনুমোদন পেতে যে আবেদন করেছিল সে সম্পর্কে তার গুরুতর উদ্বেগ ছিল। আরসিএমপি বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের কানাডার ঝঘঈ খধাধষরহ কর্মকর্তারা ঘুষের মাধ্যমে ৫০ মিলিয়ন ডলারের একটা প্রোজেক্ট পাইয়ে দেয়ার জন্য, যে প্রজেক্টের পুরো খরচ আনুমানিক ৫ বিলিয়ন ডলার, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য রিৎবঃধঢ় ব্যাবহারের অনুমতি চেয়েছিল। বিচারক তার রায়ের উপসংহারে বলেন, রিৎবঃধঢ় সমূহে যে প্রমাণসমূহ দাখিল করা হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ গুজবের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। ওই সমস্ত গুজব প্রমাণের জন্য যে সমস্ত সত্যনিষ্ঠ প্রমাণ দরকার তার কোন কিছুই আদালতে হাজির করা হয়নি। যে সমস্ত প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল তার সবই ছিল জনশ্রুতি (বা তার চেয়েও খারাপ) অন্যান্য জনশ্রুতি তার সঙ্গে যোগ করে রচিত হয়েছিল।’ জঈগচ প্রথমে দুর্নীতির সঙ্গে পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে, কিন্তু অভিযুক্ত দুজনের (বাংলাদেশ জন্ম নেয়া ঝঘঈ প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইসমাইল ও আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০১৫ সালের ১৫ নবেম্বর প্রত্যাহার করে হয়)। অবশিষ্ট তিন আসামি, ঝঘঈ জ্বালানি এবং অবকাঠামো ভাইস প্রেসিডেন্ট, কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং বাংলাদেশী-কানাডিয়ান ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী ভূঁইয়া- গত শুক্রবার শেষ হলো, যখন বিচারক নরধেইমার তিনজনকেই খালাস দিয়ে দেন। এ সিদ্ধান্ত আসে যখন সরকারী এ্যাটর্নি তানিট গিলিয়াম রিৎবঃধঢ় প্রমাণ বাদ দেয়ার বিচারকের সিদ্ধান্ত দেয়ার পর অন্য কোন সাক্ষী হাজির না করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে। বিচারক তার রুলিংয়ে বলেন যে সব তথ্য রিৎবঃধঢ় এ দেয়া হয়েছিল সেগুলো এসেছিল তিনজন বেনামী বা অবিশ্বস্ত লোকের দ্বারা পাঠানো ই-মেইল থেকে। তিনি বলেন, পুলিশ প্রথম অন্যান্য উৎসসমূহকে ইন্টারভিউ করার চেষ্টা করেনি, যদিও ওই সব বেনামীরা আর কিছু লোকের নাম দিয়েছিল এবং যাদের সঙ্গে পুলিশকে যোগাযোগ করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছিলেন। আমার বর্তমান নিবন্ধটি জনকণ্ঠে আমার আগের প্রকাশিত আগের দুটো নিবন্ধের ধারাবাহিকতায় রচিত। নিবন্ধগুলো এক ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্রকে ঘিরে আবর্তিত যেখানে কন্ট্রাক্টের ১০ থেকে ১২% ঘুষ দেয়া নেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, অর্থের পরিমাণ অবশ্য সম্পূর্ণ প্রজেক্টের প্রস্তাবিত খরচের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। সেটা সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক এবং মিডিয়া অঙ্গনে এটা কেন এত শোরগোল তুলেছে? এর কারণ হলো এ ঘটনার বাদী হলো বিশ্বের সর্বশক্তিমান আর্থিক সংস্থা এবং আসামি হলো ১৬ কোটি মানুষের উন্নয়নকামী দেশের সরকার, যে দেশের অর্থনীতি এমন স্বনির্ভর নয় যে ওই পরাক্রমশালী সংস্থাকে বিদায় জানাতে পারে। যার ফলে ওই সংস্থাটির দেয়া অর্থনৈতিক প্রেসক্রিপশন উন্নয়নশীল দেশসমূকে গলধঃকরণ করতে হয়ে, তা সে প্রেসক্রিপশন যতই তেতোই হোক না কেন। যে প্রকল্পটি নিয়ে এ নিবন্ধের অবতারণা সেটার সঙ্গে পরিচিত নয় এমন মানুষ হয়ত বাংলাদেশে খুব বেশি নেই এবং প্রকল্পটি সফল সম্পন্নতা হতে পারত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক বিরাট মাইলফলক। এটা নিয়ে আমি জনকণ্ঠে দুটো নিবন্ধ লিখেছিলাম যদিও আমি সাংবাদিক নই, অনুসন্ধিৎস তো অনেক দূরের কথা। ওই নিবন্ধে আমি সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করতে চেয়েছিলাম, যে মিথ্যাগুলো প্রচারিত হয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অপব্যবহারে, যেখানে সত্যের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়নি। অথচ যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সত্য প্রকাশ দায়বদ্ধতা হাতে হাত ধরে চলার কথা। প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা না বলে স্বেচ্ছাচারিতা বলাই ঠিক হবে। এই মামলার প্রাক-বিচার শুনানির প্রায় সমস্ত সময়টা আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম। যেহেতু শুনানির শুরুতেই মহামান্য আদালত শুনানির সমস্ত কার্যবিধি প্রকাশের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন এবং যেটা তিনি শুনানির শেষ দিনে পুনর্ব্যক্ত করেন এই বলে যে পরবর্তীতে এই মামলার পূর্ণাজ্ঞ বিচার শেষ না হওয়া অবধি সেটা বলবত থাকবে। আদালতে আমার প্রশ্নের জবাবে এ নিষেধাজ্ঞার যে কোন ভৌগোলিক সীমানা রেখা নেই এবং এটা যে ইন্টারনেটসহ সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রেও যে প্রযোজ্য সেটা মহামান্য আদালত পরিষ্কার করেছিলেন। এ ধরনের পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর সবাই তাদের ইচ্ছামাফিক সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে সংবাদ এবং নিবন্ধ প্রকাশ করে। দৈনিক প্রথম আলোর একই সংখ্যায় আর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যেটাতে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ সূত্রের বরাত দিয়ে রমেশ শাহের ডায়েরি সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছিল, যে ডায়েরি নিয়েই সমস্ত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলাটি আবর্তিত হয়েছিল। আমি সেই হাতেগোনা মানুষদের একজন যে ওই ডায়েরির সে গুরুত্বপূর্ণ পাতাটি সম্পূর্ণভাগে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এ ডায়েরির পাতাটির সত্যতা এবং বৈধতাই এ মামলার জয় পরাজয় নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক কিছু ভুল তথ্যের সঙ্গে দৈনিক প্রথম আলো লিখেছিল, ‘রমেশের হাতে লেখা ডায়েরি এই বিশেষ পৃষ্ঠায় এসএনসি-লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেসের স্বাক্ষর রয়েছে।’ সামান্য সাধারণ জ্ঞানই বলবে কারও ব্যক্তিগত ডায়েরিতে তার উর্ধতন কর্মকর্তা বা সহকর্মীর স্বাক্ষর থাকার কথা নয়। আরসিএমপি সমস্ত তদন্তটাই শুরু করছে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে। কোন অবস্থাতেই বিশ্বব্যাংক কোন ঐশী প্রতিষ্ঠান নয়, আর এক ঝাঁক ফেরেশতাও এটা পরিচালনা করছেন না। আমার জানামতে প্রাকবিচার শুরুর পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছেও ওই ডায়েরির কোন কপিও ছিল না। সে অবস্থায় কোন দলিলের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে দাবি জানিয়েছিল ডায়েরিতে যাদের নাম রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের? প্রাক-বিচার চলাকালে এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সমঝোতা চুক্তি কোন কাকতলীয় ব্যাপার নয়। যদিও প্রাক-বিচার পরিচালিত হয়েছে এসএনসি-লাভালিনের দুই প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, কিন্তু পরিশেষে এর পরিধি বিস্তারিত হয়েছিল তাদের বাইরে, যেহেতু একজন অভিযুক্ত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ ইসমাইলের কোন অর্থ প্রদানের ক্ষমতাই ছিল না এবং অন্যজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রমেশ শাহের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া যে ধরনের আর্থিক লেনদেনের কথা উঠেছে সেটার প্রতিশ্রুতি দেয়ার প্রশ্নই আসে না। রমেশ শাহর আইনজীবী ডেভিড কাজিন রায়ের পরে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জঈগচ-এর উচিত ছিল পরিষ্কারভাবে ই-মেইলকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে কাজ করা, যাদের একজন পরে আবিষ্কার হলো, একটি এসএনসির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা। ‘জনাব শাহ গত চার বছর ধরে এক ভয়ানক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছে। তিনি চাকরির অযোগ্য হয়েছেন; তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিল। তার স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছে।’ মোহাম্মদ ইসমাইল, বাংলাদেশী জন্মগ্রহণ প্রকৌশলী যিনি, গতকাল আমাকে জানালেন তার এক উজ্জ্বল কর্মজীবন কিভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যদিও তিনি ২০১৫ সালের ১৫ নবেম্বর মামলা থেকে অব্যাহতি পান, কিন্তু সব সংগঠনই তাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়ার বিবেচনা করার পরও এসএনসি মামলার সঙ্গে তার সংযোগের কারণে তারা তাকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়নি। কিভাবে তার উজ্জ্বল জীবন এসএনসি দ্বারা তার আকস্মিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তার করুন কাহিনী তিনি বললেন আমাকে। বিনা দোষে যারা তাদের উজ্জ্বল পেশাজীবন ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের শাস্তি কে দেবে? সেটা পুনর্নির্মাণের এবং যে মানসিক দুর্ভোগ ও আর্থিক ক্ষতির এই দীর্ঘ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে তারা জীবন কাটালেন তারা যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ কে দেবে? লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×