ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

বসন্তে ভালবাসা ও বিশ্বের তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বসন্তে ভালবাসা ও বিশ্বের তারুণ্য

স্কুলের দেয়াল বা কলেজের বেঞ্চগুলোর কথা কি মনে পড়ে? কলমের আঁচড়ে, স্কেলের কাটাকুটিতে নানাভাবে, নানা ভঙ্গিমায় প্রথম ভালবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন আপনাদের অনেকেই। কিন্তু সে অনুভূতি তো ছোটবেলা কিংবা বড়বেলার ওই একান্ত ব্যক্তিগত ভাল লাগা আর লাজুক প্রকাশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কজনই বা জেনেছেন এমন ভাল লাগার কথা? যাকে ভালবাসা জানিয়েছেন তিনিও কি জানতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত? ভালবাসা শব্দটি খুব সহজেই সকলের সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে মিশে যায়। কেননা জন্মের পর থেকেই মানুষের বেড়ে উঠা এই ভালবাসাকে কেন্দ্র্র্র করেই। আর তাই ভালবাসার দিনটিকে নিয়ে সকলের ভাবনাটাও থাকে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ অর্থাৎ ভালবাসা দিবসের ইতিহাস কমবেশি সবাই আমরা জানি। এই ভালবাসা দিবসকে বিশ্বের নানান দেশের তরুনরা কিভাবে পালন করে আসুন জেনে নেই সেই বিচিত্র তথ্য। মধ্যযুগে তরুণ এবং তরুণীরা বাটির পেয়ালা থেকে নিজ নিজ ভ্যালেন্টাইনদের নাম লেখা চিরকুট উঠিয়ে নিয়ে জামার আস্তিনে গেঁথে রাখত। এভাবে থাকত পুরো এক সপ্তাহ। কোন কোন দেশে তরুণ কোন তরুণীকে এক টুকরো কাপড় উপহার দিত। তরুণীটি সেই কাপড়ের টুকরো রেখে দিলে মনে করা হতো, তরুণের ভালবাসা সে গ্রহণ করেছে। অনেকে বিশ্বাস করত, ভ্যালেন্টাইন দিনে কোন মেয়ের মাথার ওপর দিয়ে যদি কোন গায়কপক্ষি উড়ে যায়, তাহলে মেয়েটির বিয়ে হবে কোন নাবিকের সঙ্গে। কোন মেয়ে যদি কাক দেখে, তাহলে তার বিয়ে হবে কোন দরিদ্রের সঙ্গে কিন্তু সুখে থাকবে। যদি মেয়েটি কোন ফিঙ্গেপাখি দেখে, তাহলে তার বিয়ে হবে কোন ধনবান মিলেনিয়রের সঙ্গে। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে জাপানের তরুনীরা তাদের পরিচিত সব পুরুষকে চকোলেট উপহার দেয়। ‘গিরি চকো’ (বিশেষ নকশার ও স্বাদের চকোলেট) উপহার দেয়া হয় সহকর্মীদের বা কাছের বন্ধুদের। ‘গিরি’ অর্থ হলো কর্তব্য, আর তাই এই উপহারের চকোলেটগুলো কোন রোমান্টিকতা বহন করে না। মেয়েরা ‘হনমেই চকো’ নামের আরেক ধরনের চকোলেট উপহার দেয় শুধু ভালবাসার মানুষটিকে। মার্চের ১৪ তারিখে শুভ্র দিবস পালন করা হয়। এ দিনটিতে তরুনরা বান্ধবীদের থেকে পাওয়া উপহারের প্রতিদান দেয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি দামের উপহার দিয়ে। সমমূল্যের উপহার ফেরত দিলে তা সম্পর্কের ইতি টানার সমান হয়। পুরনো দিনে গ্রেট ব্রিটেনের ভালবাসা দিবসের আগের রাতে মেয়েরা তাদের বালিশের চার কোনে তেজপাতা গেঁথে ও ডিমের সাদা অংশ খেয়ে ঘুমাতে যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল এতে তারা স্বপ্নে হবু বরকে দেখতে পাবে! এ ছাড়া, তারা টুকরো টুকরো কাগজে প্রেমিকদের নাম লিখে মাটির দলায় আটকে পানিতে ছেড়ে দিত। যার নাম লেখা কাগজের টুকরোটি আগে ভেসে উঠত, সেই হবে তাদের হবু বর! এসব কুসংস্কার এখন লোককথা হিসেবে ঠাঁই করে নিলেও ব্রিটেনের কোথাও কোথাও এগুলো এখনও পালন করতে দেখা যায়। জার্মানির কোলনে। সেখানকার হোসনলানব্রোকা ব্রিজটির ধারে গেলেই দেখা যায়, হাজারো তালা দিয়ে ছেয়ে গেছে ব্রিজটি। ভালবাসার বাঁধনে জড়ানো কপোত-কপোতীরা নিজেদের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতেই এখানে এসে ব্রিজের গায়ে লাগিয়ে রেখে যায় এসব তালা। ‘লাভ লক’ বা ‘লাভ প্যাডলক’ লাগানোর ঘটনাটি এখন প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এক আকর্ষণীয় ব্যাপার। ব্রিজের ওপর নিজের প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার স্মৃতিবিজড়িত তালা রেখে যাওয়ার ঘটনা অবশ্য এটাই একমাত্র নয়। ফ্রান্সের প্যারিসের বিখ্যাত লাভলক ব্রিজে তরুণ তরুণীরা তালা রেখে যায়। অনেকের মতে, প্রেম প্রকাশের আজব এ প্রথা প্রথম শুরু হয় ইতালিতে। অতল ভালবাসার সাক্ষীস্বরূপ প্রেমিক জুটি তাদের ভালবাসার মানুষটির নাম লেখা তালা চাবি দিয়ে লাগিয়ে রাখা আরম্ভ করে বেড়া, দরজা, ব্রিজসহ নানা জায়গায়। ইতালির রোমের অনি মিলভিও ব্রিজে প্রেমিক-প্রেমিকাদের লাভলক লাগানোর কথা উঠে এসেছে ইতালীয় লেখক ফেদেরিকো মোয়াচ্চার ‘আই ওয়ান্ট ইউ’ বইতেও। একই ধরনের ব্রিজ দেখা যায় সার্বিয়াতে, যেখানে ভালবাসার তালা লাগানোর শুরু সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই। এ ব্রিজে তালা লাগানোর রীতি নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একটি প্রেমের গল্প। মিয়াশকা বানজা নামের এক জায়গায় বাস করত নাদা নামের এক স্কুল শিক্ষিকা, যে কিনা রেলজা নামের এক সার্বিয়ান অফিসারের প্রেমে পড়ে। তারা একে অপরকে ভালবাসতে শুরু করেছে, এমনই সময় একদিন রেলজাকে যুদ্ধ করার জন্য যেতে হয় গ্রিসে, । সেখানে রেলজা আবার আরেক মেয়ের প্রেমে পড়ে। বেচারি নাদা কখনই নিজের প্রেমের এমন পরিণতি মেনে নিতে পারেনি, তাই এ ঘটনার কিছুদিন পরই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ভার্নজাকা বানজার মেয়েরা তাই এ ঘটনার স্মরণে আর নিজেদের ভালবাসা রক্ষা করতে নিজের আর প্রেমিকের নাম লেখা তালা লাগিয়ে রাখে, ঠিক সেই ব্রিজের রেলিংয়ে, যেখানে কোন একসময় দেখা করত নাদা আর তার প্রেমিক রেলজা। জার্মানির কোলনে যে লাভলক ব্রিজ রয়েছে, তা ওখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রিজগুলোর একটি। ভিয়েতনামের হ্যানয় থেকে ৫০০ কিলোমিটার উত্তরে চীনের সীমান্তের ধারে পাহাড়ের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা খাউ ভাই গ্রামের মানুষ প্রতিবছর তারা অন্তত একবার নিজেদের পুরনো প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করে। শুধু তাই নয়, সে সময় সঙ্গে করে নিজের বর্তমান ভালবাসার মানুষকেও নিয়ে আসে, যাতে সবাই একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করতে পারে। তৃতীয় চান্দ্র মাসের ২৬ ও ২৭ তারিখে ‘লাভ মার্কেট’ নামে জনপ্রিয় এই রীতি অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিতে আশপাশের সব আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ ছুটে আসে। নুং, তায়, সান চি, লো লো, ডিজাও, গিয়েই আর হিমং নামের গোষ্ঠীর মানুষের এক মিলনমেলা বসে এ দুদিন। যাদের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানো সম্ভব হয়নি, তাদের সঙ্গে খানিকটা সময় পার করেই যেন দারুণ খুশি এসব মানুষ।
×