ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চা শিল্পের উন্নয়নে নব জাগরণ সৃষ্টি;###;চা উৎপাদনের জন্য অর্থায়ন খুব জরুরী

ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণে সর্বাত্মক সহযোগিতা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণে সর্বাত্মক সহযোগিতা

কাওসার রহমান ॥ দেশে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের কথা জানালেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। দেশের চা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে চায়ের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশকে দেশে চায়ের উৎপাদন তিনগুণ বাড়লেও কয়েক বছর ধরে আমদানি করে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। তিনি জানান. বাংলাদেশের এক সময়ের প্রধান অর্থকরী ফসল চা-কে আবার রফতানির পর্যায়ে নিয়ে যেতে সম্প্রতি চা শিল্পের বিকাশে নতুন একটি পথনকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। চা শিল্পের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে দেশী চায়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে আমরা গত ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক চা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি। মেলায় দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো অংশ নেয়। এতে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের কাছে দেশীয় চায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং নানা ব্র্যান্ডের চায়ের গুণাগুণ ও চা শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার চিত্র প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি সেমিনার, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, পোস্টার, লিফলেট বিলি ইত্যাদি কার্যক্রমও চলে। এই মেলা আয়োজনে আমরা অত্যন্ত সফল হয়েছি। মেলায় উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। মেলার মাধ্যমে আমরা চা সম্পর্কে সাধারণ ক্রেতা ও উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বেশ ভাল সাড়া পেয়েছি। উল্লেখ্য, প্রথম চা মেলায় দেশের শীর্ষস্থানীয় চা বাগান, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন সংস্থা এবং চা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নেয়। এতে মোট ১৬টি স্টল ও ৩০টি প্যাভিলিয়ন ছিল। চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ্য করে তোফায়ের আহমেদ বলেন, দেশের চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু তার বিপরীতে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও অনেক বেড়েছে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অনেক উন্নতি হয়েছে। শহরের মতো বিদ্যুত আছে। গ্রামের আনাচে কানাচে পর্যন্ত রাস্তা পাকা হয়েছে। গ্রামের মানুষের হাতে এখন পয়সা আছে। ফলে ঘরে ঘরে মানুষ চা খায়। রাস্তার পাশে দোকানে বসে মানুষের চা খাওয়ার দৃশ্য এখন সাধারণ ব্যাপার। এ কারণ দেশে চায়ের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে দেশে ২৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হতো। তখন দেশ থেকে চা রফতানি হতো। গত বছর (২০১৫) দেশে ৬৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। আর এ বছর (২০১৬ সালে) দেশে ৮৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করার পরও রফতানি দূরের কথা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আমাদের কিছু পরিমাণ চা আমদানি করতে হয়েছে। দেশে চায়ের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া একটি ইতিবাচক দিক। আমরা যে উন্নতি করছে, আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যে শক্তিশালী হচ্ছে, দেশ যে সমৃদ্ধ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে এটা তারই লক্ষণ। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে দেশে চা আমদানি হয়েছে ১১ দশমিক ৪ মিলিয়ন কেজি। আর রফতানি হয় ০ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন কেজি। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে দেশে চা আমদানি করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭০ মিলিয়ন কেজি এবং রফতানি হয়েছে দশমিক ৪৭ মিলিয়ন কেজি। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বিগত চার দশকে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। এর বিপরীতে চায়ের ব্যবহার বেড়েছে ১২ গুণ। ফলে এক সময়ের রফতানিমুখী চা এখন উল্টো আমদানি হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা ১০ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি পথ নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। ‘উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদেশ চা শিল্প’ শীর্ষক কর্মপরিকল্পনায় ১০টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রতিষ্ঠিত চা বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানের মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন। এ লক্ষ্যে আমাদের অতিরিক্ত ৭২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনক করতে হবে। এজন্য আমরা নতুন করে আরও ১০ হাজার হেক্টর জমি চা আবাদের আওতায় আনব এবং আগের ১০ হাজার হেক্টরে বিদ্যমান অতিবয়স্ক ও অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক গাছ উত্তোলন করে পুনঃরোপন করব। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে হেক্টর প্রতি জাতীয় গড় উৎপাদন ১২৭০ কেজি থেকে ১৫০০ কেজিতে উন্নীত করা। চা চাষে জমির গড় ব্যবহার ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশে উন্নীত করা। অতিরিক্ত উৎপাদিত চা প্রক্রিয়াকরণের জন্য কারখানা সুবিধা উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৮৩৮টি চা প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র সংগ্রহ করা। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ১৬২টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ ৬৪ হাজার ৮৮৬ দশমিক ২৫ হেক্টর। তবে চা চাষ হয় মোট ৫৯ হাজার ১৮ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও বান্দরবান জেলায় চা বাগান রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশে এখন ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ বিস্তার লাভ করছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা উদ্যোক্তারা চা উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভাল ভূমিকা রাখছে। আমাদের দেশেও ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দেব। আমরা যে চা মেলা আয়োজন করেছি তাতে চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সব প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছে। এতে দেশের চা শিল্পের উন্নয়নে একটি নব জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এই জাগরণকে আমরা ধরে রাখতে চাই। এজন্য চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষতে আমরা সহায়তা করব। চা উৎপাদানে অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চা উৎপাদনের জন্য অর্থায়ন খুব জরুরী। চা উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। চা চারা লাগানোর পর ৬-৭ বছর লেগে যায় টাকা ফেরত আসতে। এটি একটি সময় সাপেক্ষ বিনিয়োগ। তাই উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ খুব প্রয়োজন। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছি। কিভাবে চা উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রদানে সহায়তা করা যায়। চায়ের ব্রান্ডিং প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে চা চাষের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও দেশের চায়ের নিজস্ব কোন ব্রান্ড তৈরি হয়নি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে চা বিপণনের জন্য ব্রান্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী ব্রান্ডেড চা অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিভিন্ন নামে আমাদের চায়ের ব্রান্ড তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এটা করা সম্ভব হলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশেী চায়ের পরিচিতি বাড়বে। উন্নত মানের বাংলাদেশীয় চা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করবে। পঞ্চগড়ে সরকারী উদ্যোগে একটি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রাধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়ে থাকলে তা অবশ্যই আমরা পালন করব। উল্লেখ্য, সরকারী উদ্যোগে পঞ্চগড়ে একটি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপনের ব্যাপারে এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেন। ওই চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পঞ্চগড়ে সরকারী উদ্যোগে চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা করার নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। তার একটি অনুুলিপি তাকেও দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে লেখা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই চিঠিতে বলা হয়, জুলাই ২০১৬ এর দ্বিতীয় পক্ষের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নিম্নোক্ত প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী সমীপে উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি হলো- ‘২০০০ সাল থেকে পঞ্চগড় জেলার সমতল ভূমিতে চা চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে উক্ত জেলায় ২৫০টি চা বাগান রয়েছে। চা চাষী, বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে প্রতিবছর সভা করে চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চা ফ্যাক্টরির মালিকগণ চা পাতা ক্রয়ের সময় সিন্ডিকেট করে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কমে চা পাতা ক্রয় করে। উক্ত জেলায় বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানাধীন ৪টি ফ্যাক্টরি সচল রয়েছে। তবে, সরকারী কোন চা ফ্যাক্টরি নেই। এতে ক্ষুদ্র চাষীগণ ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এজন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষাক্রমে পঞ্চগড় জেলায় একটি চা প্রক্রিয়াকরণ ফ্যাক্টরি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, উক্ত প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী সদয় অনুমোদন করেছেন। এমতাবস্থায়, উল্লিখিত অনুশাসন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে দুই মাস অন্তর অন্তর অগ্রগতি প্রতিবেদন এ বিভাগে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
×