ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

ফুল ফাগুনের প্রাঙ্গণ আজ ভরে উঠবে ভালবাসায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফুল ফাগুনের প্রাঙ্গণ আজ ভরে উঠবে ভালবাসায়

মোরসালিন মিজান ॥ আজি দখিন-দুয়ার খোলা-/ এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো...। বসন্ত এসেছিল মেলায়। রাজধানী শহরের অলি গলিতে সেই সক্কাল বেলায় যে ঢেউ দেখা গিয়েছিল, সেটি বিকেলে আছড়ে পড়ে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একই সময় চারুকলায় চলছিল বসন্ত উৎসব। কলা ভবনের বটতলা, টিএসসিসহ আশপাশের এলাকায়ও উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিকেল ৩টায় প্রবেশ দ্বার খুললে মেলায় প্রবেশের অনুমতি পায় বসন্ত! অনুমতি পায় বলার কারণ, মেলা এদিন বেলা ১১টায় শুরু করা যেত। খুব প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। বাঙালীর এত বড় একটি উৎসবের সঙ্গে মেলার সংযোগ ঘটাতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না আয়োজকরা। তাই বিকেলে গেট খুলার পর সবাই আসতে থাকেন। দেখতে দেখতে আমূল বদলে যায় মেলার চেহারা। গাঁদা ফুলের আগুন রং। হলুদ চন্দ্রমল্লিকা। গ্ল্যাডিওলাস। সব খোঁপায় করে নিয়ে এসেছিলেন প্রাণোচ্ছল তরুণীরা। ফ্লাওয়ার ক্রাউন এখন খুব জনপ্রিয়। ক্রাউন পরেনি তেমন একটি মেয়ে খুঁজে বের করা মুশকিল ছিল। তার পর ঘুরে বেড়ানো। বইয়ের পাতা উল্টে দেখা। বিভিন্ন স্টলের কর্মীরাও হলদু রঙের টিশার্ট পাঞ্জাবি শাড়ি পরেছিলেন। মেলায় গণমাধ্যমকর্মীদেরও বিশাল টিম কাজ করছে। তাদেরও দেখা গেল বাসন্তী রঙে সেজে আসতে। মম প্রকাশ’র সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তো অবাক হয়ে যাওয়ার পালা। কবিগুরুর সুর বাজছে। মিষ্টি সুরে বসন্তের আবাহন। এভাবে ফুল ফাগুনের প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠেছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাসন্তী রঙের আশ্চর্য সুন্দর উৎসবে পরিণত হয়েছিল ত্রয়োদশতম দিন। বসন্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বই। কিছু সময় মেলা ঘুরে অনুমান করা গেল, যারা এসেছেন তাদের বৃহৎ অংশটি তরুণ-তরুণী। জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যেই বেশি আগ্রহ দেখান তারা। হুমায়ূন আহমেদের বই যেসব স্টলে সেগুলোতে ভিড় লেগেছি। তাম্রলিপির প্যাভিলিয়নে প্রয়াত লেখকের পুরনো লেখার নতুন উপস্থাপনা। তা-ই কিনছিলেন পাঠক। এখান থেকে সামনে এগিয়ে গেলে অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়ন। নন্দিত লেখকের অনেক সৃষ্টি দিয়ে সাজানো। ভিড়ও বেশি। প্রচুর বিক্রি হচ্ছিল। কাছাকাছি দূরত্বে কাকলী প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন। এখানেও মূল লেখক হুমায়ূন। প্রকাশকের কথা ॥ হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকদের অন্যতম নাসির আহমেদ সেলিম। নিজের প্যাভিলিয়নেই ছিলেন তিনি। বললেন, আমার হুমায়ূন আহমেদ সব সময়ই যায়। বসন্তের দিনে লোকসমাগম বেশি। আজ বিক্রিও বেশি। তিনি জানান, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রেষ্ঠ মিসির আলী’, ‘গল্প সমগ্র’ এবং নতুন আসা ‘কথামালা’ এদিন বেশি বিক্রি হয়েছে। আজ বইয়ের সঙ্গে ভালবাসা ॥ আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার। ভালবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেনটাইন ডে। এদিনটিও দারুণ আবেগ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদযাপিত হয় শহর ঢাকায়। ভালবাসার উত্তাপ ছড়ায়। অমর একুশে গ্রন্থমেলাও আজ ভালবাসার হবে। এক হাতে বই আর অন্য হাতে থাকবে গেলাপ। ভালবাসার লাল রঙে বদলে যাবে মেলার চেহারা। বিগত বছরগুলোর ভালবাসা দিবস পর্যবেক্ষণ করে এই ভবিষ্যতবাণী করাই যায়। অবশেষে লেখকদের নামে চত্বর ॥ বহু সমালোচনার পর ত্রয়োদশতম দিনে এসে বাংলা একাডেমির মনে পড়েছে, প্রয়াত লেখক কবি ও বিশিষ্টজনদের স্মরণ করার কথা। এদিন মেলায় প্রবেশ করতেই দেখা যায়, এখানে ওখনে চৌবাচ্চার মতো কাঠের বাক্স। বাক্সের গায়ে ডিজিটাল ব্যানারে প্রয়াত ব্যক্তিত্বদের ছবি। নাম। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কর, দীনেশচন্দ্র সেন, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, নূরজাহান বেগম, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আবদুল গফুর হালী, সরদার জয়েনউদ্্দীন, আমীর হোসেন চৌধুরীর নামে মেলায় চত্বর ঘোষণা করা হয়েছে। ৭১ নতুন বই ॥ একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে জানানো হয়, গতকাল মেলার ১৩তম দিনে নতুন বই এসেছে ৭১টি। এগুলোর মধ্যে গল্প ১১, উপন্যাস ৬, প্রবন্ধ ৬, কবিতা ২৭, জীবনী ৩, মুক্তিযুদ্ধ ২, নাটক ১, ভ্রমণ ১, রাজনীতি ১, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ২, অনুবাদ ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর আরও ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এদিন আসা বইগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ সৈয়দ শামসুল হকের ‘অনুবাদ কবিতা সমগ্র’ ও ‘রক্তগোলাপ’, মাওলা ব্রদার্স; আহমদ ছফার ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’, কালীকলম প্রকাশনা; নির্মলেন্দু গুণের ‘কবিতা, অমীমাংসিত, রমনী’, কবি প্রকাশনী; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘তাজউদ্দিন আহমেদের রাজনৈতিক জীবন’, মুক্তধারা। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ১৪টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শফিউল আলম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. সফিউদ্দিন আহমদ এবং ড. রতন সিদ্দিকী। সভাপতিত্ব করেন প্রাবন্ধিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় একজন কবি, বাংলা ভাষা-ভাষী শিশুদের জন্য তিন খ- ‘শিশুশিক্ষা’ প্রণয়নকারী, নারীশিক্ষার প্রবক্তা, বিধবা-বিবাহের সক্রিয় সমর্থক, কুসংস্কারমুক্ত মানুষ ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। মদনমোহন যখন সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নরত তাঁর কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে অধ্যাপকম-লী তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘কবি রতœাকর’, তাঁর বন্ধুরা উপাধি দিয়েছিল ‘তর্কালঙ্কার’। তিনি কলকাতায় থাকতে মহাত্মা ডিরোজিওর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। প্রাবন্ধিক বলেন, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন আপাদমস্তক একজন মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। আলোচকরা বলেন, উনিশ শতকের বাংলা-রেঁনেসার সন্তান মদনমোহন তর্কালঙ্কার একজন প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। রক্ষণশীলতা ও ধর্মান্ধোতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে সমাজকে মুক্ত করার জন্য তিনি আত্মনিবেদন করেছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসার ও বিধবা বিবাহ প্রচলনে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম সমাজের অপশক্তি ও কুসংস্কার দূর করার লক্ষ্যে আমাদের ভাবী প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে যাবার পথ দেখাবে সবসময়। সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা হয় তাঁদের অন্যতম মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, সৃষ্টিশীল ও মননশীল। শিশুশিক্ষা থেকে নারীশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা সর্বক্ষেত্রেই রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। সবমিলিয়ে তিনি একজন রেনেসাঁ-মানব। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল বাফার পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী সুবীর নন্দী, জীনাত রেহানা, দীনাত জাহান মুন্নী, অনন্যা আচার্য এবং সঞ্জয় কুমার দাস।
×