ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লড়াকু হার মুশফিক বাহিনীর

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

লড়াকু হার মুশফিক বাহিনীর

মিথুন আশরাফ, হায়দরাবাদ থেকে ॥ ভারতের তিন শতক ও তিন অর্ধশতকের জবাবে বাংলাদেশের এক শতক ও তিন অর্ধশতক। ভারতের তিন বোলারের ৩ উইকেট করে শিকার করার বিপরীতে বাংলাদেশের এক বোলারের তিন উইকেট নেয়া। এখানেই তো টেস্টের ‘নাম্বার ওয়ান’ দল ভারত ও ‘নাম্বার নাইন’ দল বাংলাদেশের পার্থক্য স্পষ্ট ধরা পড়ে। এর সেেঙ্গ ভারতের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের বিপরীতে বাংলাদেশের বাজে ফিল্ডিং সবাইকেই হতাশ করেছে। ভারতের ব্যাটসম্যানদের আউট হওয়ার ধরন আর বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের অহেতুক আউট হওয়ার অভ্যেসও দুই দলকে আলাদা করেই রেখেছে। তবুও বাংলাদেশ যে ২০৮ রানে হায়দরাবাদ টেস্টে হেরেছে, সেখানে ছিল লড়াই। টেস্ট পাঁচদিনে গড়িয়েছে। দ্বিতীয় সেশনের আগ পর্যন্ত খেলা গেছে। এটিতেই লড়াইয়ের ভাব মিলে যায়। সেই লড়াকু হারই হয়েছে বাংলাদেশের। বিরাট কোহলির দ্বিশতক (২০৪), মুরলি বিজয় (১০৮) ও ঋদ্বিমান সাহার (১০৬*) শতক, চেতশ্বর পুজারার দুই ইনিংসেই অর্ধশতক (৮৩ ও ৫৪*) ও অজিঙ্কেয়া রাহানের (৮২) আশির ঘরে রান। এর বিপরীতে বাংলাদেশের মুশফিকুর রহীমের শতক (১২৭), সাকিব আল হাসানের (৮২) আশির ঘরে রান, মেহেদী হাসান মিরাজ (৫১) ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের (৬৪) অর্ধশতক বড্ড বেমানানই লাগছে। বল হাতে বাংলাদেশের স্পিনার তাইজুল ইসলামই শুধু এক ইনিংসে ৩ উইকেট নিতে পেরেছেন। সেখানে ভারত পেসার উমেশ যাদব, বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে ত্রাস সৃষ্টি করা দুই স্পিনার অশ্বিন ও জাদেজা ৩ উইকেট করে তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশ বোলারদের দক্ষতা ও ভারত বোলারদের দক্ষতার মধ্যে কত পার্থক্য। আছে আবার ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের এক গাদা ফিল্ডিং মিস করা, ক্যাচ ছাড়া, স্ট্যাম্পিং মিস করার দুর্বলতাও। এ সবকিছুর চেয়ে যেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের বাজে শট খেলে আউট হওয়ার প্রবণতাই বেশি ভুগিয়েছে। প্রথম ইনিংসে সাকিব, দ্বিতীয় ইনিংসে মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ প্রযোজনের মুহূর্তে বড় ইনিংস খেলার আশা দেখিয়েও বাজে শটে আউট হয়ে যান। তাতেই আসলে বাংলাদেশ ব্যাকফুটে চলে যায়। প্রথম ইনিংসে ভারত ৬৮৭ রান করে ইনিংস ঘোষণা করেই তো বাংলাদেশকে টেস্ট হারার গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। সেখান থেকে তাও লড়াই চালিয়ে যান বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। প্রথম ইনিংসে ৩৮৮ রান করে। কিন্তু পিছিয়ে থাকে ২৯৯ রানে। ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করলে বাংলাদেশের সামনে জিততে ৪৫৯ রানের টার্গেট পড়ে। এ টার্গেট যে অতিক্রম করা সম্ভব নয়, তা সবারই জানা। কিন্তু ম্যাচ তো ড্র করা সম্ভব। সেই কাজটিই তো বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা করতে পারল না। উইকেট আঁকড়ে থাকতে হবে। এটিই যখন টার্গেট। সেটিই করতে পারল না। দুই স্পিনার অশ্বিন ও জাদেজা মিলেই ডুবিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। চতুর্থদিন ৩ উইকেটে ১০৩ রান করেছিল বাংলাদেশ। জিততে হলে ৩২৬ রান করতে হতো। একদিনে চাইলে তা করা সম্ভব। কিন্তু সেই কাজটি করতে গেলে হারার ঝুঁকিই থাকে। তাই উইকেটে যত বেশি টিকে থাকা যায়, সেই লক্ষ্যই নির্ধারণ করা ভাল। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যায়। কিন্তু চতুর্থদিন অপরাজিত থাকা দুই ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ ও সাকিব সেই লক্ষ্য শেষপর্যন্ত পূরণ করতে পারলেন না। পঞ্চমদিনের শুরুতেই সাকিব আউট হয়ে যান। এরপর প্রথম ইনিংসে শতক করা মুশফিকও বাজে শট খেলে আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। ম্যাচ বাঁচাতে হলে একটি বড় জুটির দরকার। সেই জুটিটিই তো হলো না। চতুর্থদিন যে শুরুতেই হায়দরাবাদ টেস্টে ‘ফ্লপ’ হওয়া তামিমের আউটের পর সৌম্য ও মুমিনুল মিলে ৬০ রানের জুটি গড়েছেন, সেটিই দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি হয়ে থাকল। এমন দুর্দশা হলে কী ম্যাচ থেকে ভাল ফল বের করে আনা সম্ভব। মাঝপথে মাহমুদুল্লাহ ও সাব্বির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ২১৩ রানের সময় সাব্বিরের আউটের কিছুক্ষণ পরই দ্বিতীয় ইনিংসে সর্বোচ্চ ৬৪ রান করা মাহমুদুল্লাহ আউট হয়ে যান। দল যে ব্যাটসম্যানদের ওপর নির্ভর করে, তারা সবাই আউট হয়ে যান। এরপর বোলারদের মধ্যে মিরাজ ব্যাটিং করতে পারেন। তিনি অলরাউন্ডার। কিন্তু রাব্বি, তাইজুল ও তাসকিন তো ব্যাটসম্যান নন। তাই স্বাভাবিকভাবেই হার যেন সময়ের বিষয়ে হয়ে দাঁড়ায়। তাতে করে মাহমুদুল্লাহ ২২৫ রানে আউটের পর আরও ২৫ রান যোগ হতেই ২৫০ রান হতেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। তবে এরমধ্যে কামরুল ইসলাম রাব্বি দেখান ব্যাটিং ঝলক। উইকেট কিভাবে আঁকড়ে থাকতে হয়, রাব্বি ৭০ বলে অপরাজিত ৩ রান করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দলের যখন ২৫০ রান, তখন অশ্বিনের বলটি তাসকিনের পায়ে লাগে। ‘রিভিউ’ নেয় ভারত। তাতে সফলও হয় ভারত। থার্ড আম্পায়ার লাল বাতি জ্বালান। আউটের সংকেত দেন। তাসকিনের আউটেই অলআউট হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশেরও হায়দরাবাদ টেস্টে লাল বাতি জ্বলে যায়। এরপরও ভারতের মাটিতে প্রথমবার খেলতে নেমে বাংলাদেশ যে লড়াকু মনোভাব দেখিয়েছে, তাতে প্রশংসাই কুড়াচ্ছে। ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিও প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, ‘প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ দারুণ ব্যাটিং করেছে।’ বাংলাদেশের হারের কারণ যে ফিল্ডিং এবং ভারতের ব্যাটসম্যান ও বোলারদের থেকে পিছিয়ে থাকা, সেটিকেই সামনে তুলে ধরলেন। বলেছেন, ‘প্রথম ইনিংস ভাল হয়েছে। আমরা বোলিংয়ে অনেক সুযোগ তৈরি করেছি। ভারতের অনেক অপশন। শুধু স্পিনাররাই না, ফাস্ট বোলারও দারুণ। আশা করছি আমরা এখান থেকে শিক্ষা নেব। সামনে তা কাজে লাগাবে। আমরা দুই ইনিংসে এক শ’ ওভার (প্রথম ইনিংসে ১২৭.৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১০০.৩ ওভার) ব্যাটিং করেছি। মেহেদী হাসান মিরাজ দুর্দান্ত ব্যাটিং ও বোলিং করেছে। তাইজুল ইসলামও ভাল ব্যাটিং করেছে।’ বাংলাদেশকে জিততে হলে ইতিহাস গড়তে হতো। এখন পর্যন্ত কোন দলই ৪১৮ রানের বেশি টার্গেট নিয়ে জিততে পারেনি। বাংলাদেশ জিতলে ইতিহাস হতো। বাংলাদেশ আবার নিজেদের ইতিহাসেও কখনই ২১৫ রানের বেশি টার্গেট নিয়ে জিততে পারেনি। বাংলাদেশকে জিততে হলে তাই সব ইতিহাসই ‘ওলট-পালট’ করতে হতো। সেটি সম্ভব ছিল না। তা সবারই জানা ছিল। তবে ব্যাটসম্যানরা ভুল না করলে ড্র’ও হতে পারত। এই যে ড্র হতে পারত ধারণা জন্ম হয়েছে সবার ভেতর, ভারত ক্রিকেটারদের ভেতরও; সেটিই বড় প্রাপ্তি হয়ে ধরা দিচ্ছে। খেলা পাঁচদিনে গড়িয়েছে। বড় হার হয়েছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে রানের দিক দিয়ে ভারত সবচেয়ে বড় জয়টিও পেয়েছে। এই জয়ের পরও একটা সময় যে ড্র’র আশা জেগেছিল, তাতে লড়াকু হারের খেতাব পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
×