ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে

সেদিন খালেদা, ফখরুল ইফতেখার, বদি ও মান্না যা বলেছিলেন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সেদিন খালেদা, ফখরুল ইফতেখার, বদি ও মান্না যা বলেছিলেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পদ্মা সেতুর কাজে বিশ্বব্যাংকের আজগুবি অভিযোগ ইস্যুতে সরকার যখন কিছুটা বেকায়দায় তখন কেবল বিএনপি নয়, সুশীল সমাজের ‘ব্যানারে’ রীতিমতো সরকারবিরোধী মনোভাব নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। কানাডার আদালতের রায়ে দুর্নীতির প্রমাণ না হওয়া ও মামলায় জড়িত সকল পক্ষ নিরপরাধ বলে প্রমাণের পর এখন অনেকেই হঠাৎ করে সুর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যোগ দিয়ে কিছু বলেননি- এমন ভাব নিয়েও অনেকে চুপ হয়ে গেছেন। তবে পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যায় ‘নিরপেক্ষ’ চেহারা নিয়ে মাঠে সক্রিয় অনেকেই তখন দেশের পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধে অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্বব্যাংককে রীতিমতো সহায়তা করেছিলেন। রবিবার সংসদে দাবি ওঠে- পদ্মা সেতু দুর্নীতি ইস্যু নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ যারা অপপ্রচার চালিয়েছিলেন তাদের সবাইকে ক্ষমা চাইতে হবে। দেখে নেয়া যাক ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে’ এই মর্মে বিএনপি, সুশীল সমাজ ও কথিত অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো কী বলেছিল সেই সময়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে একপর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। তার পদত্যাগ নিয়েও সমালোচনা করে কথিত সুশীল সমাজসহ বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কানাডার একটি আদালতের রায়ে সব অভিযোগ গালগল্প, আজগুবি, কাল্পনিক প্রমাণ হওয়ার পরই বিএনপি এখন সুর পাল্টানো শুরু করেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে কানাডার আদালত রায় দেয়ার পরই সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে বিএনপি। তবে ওই রায় তাদের বিবেচনার বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থ বন্ধ করে দিয়েছিল- এটাই বাস্তবতা। আদালত কিংবা কানাডার কোন আদালতের রায়ের বিষয়ে আমরা কখনই কোন উক্তি করিনি। আমাদের সে সময়ে যেটা বক্তব্য ছিল, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এখন কোথায় কী প্রমাণ হলো, না হলো সেটা তো আমাদের বিষয় নয়। অথচ বিশ্বব্যাংকের আজগুবি অভিযোগ ইস্যুতে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে সরকাররকে বেকায়দায় ফেলতে নিজের গুলশান অফিসে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর এই প্রথম বিশ্বব্যাংক তার দেয়া বরাদ্দ দুর্নীতির কারণে বাতিল করল। দুর্নীতি দমন কমিশন আবুল হোসনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এই সরকার পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি করেছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে পদ্মায় দুটি সেতু করব।’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার ১০ মাস পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ প্রমাণ করছে যে অভিযোগটি সঠিক ছিল। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে তা প্রমাণিত। যদি সে আরও আগে পদত্যাগ করত, তাহলে হয়ত বরাদ্দ বাতিল করা হতো না।’ অপর এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল দাবি করেন, ‘বিশ্বব্যাংক যে তিনজনের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তুলছে তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনাও একজন।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আবুল হোসেন দেশপ্রেমিক নয়। সে একজন নির্লজ্জ ব্যক্তি, যে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ আনার পরও ১০ মাস ক্ষমতা ধরে রেখেছিল।’ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এএসএম হান্নান শাহ বলেছিলেন, আবুল হোসেনকে অনুসরণ করে দেশপ্রেম প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীরও উচিত পদত্যাগ করা। শেখ হাসিনা দুর্নীতিগ্রস্ত এক প্রধানমন্ত্রী এবং তারও পদত্যাগের মাধ্যমে একটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করা উচিত।’ বিএনপিপন্থী অন্যতম বুদ্ধীবীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, যদি আবুল হোসেন একজন দেশপ্রেমিক হয়ে থাকে, তাহলে কে দেশপ্রেমিক নয়? প্রাথমিক অবস্থায় আবুল হোসেনকে সমর্থন দেয়ায় একটি বার্তাই সাধারণ মানুষ পায়। আর তা হলো, সাধারণ মানুষের টাকা যারা ডাকাতি করে, তাদেরই রাজনীতিতে আসার অধিকার রয়েছে। কাডানার আদালতে রায়ের পর অনেকটাই আগের সেই নেতিবাচক অবস্থান থেকে সরে এসেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি এখন বলছেন, অভিযোগ প্রমাণের আগেই বিশ্বব্যাংক কেন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করল তার জবাব সরকারকে চাইতে হবে। সংক্ষুব্ধ পার্টি হিসেবে সরকারের এ জবাব চাওয়া উচিত বলেও মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। বলছেন, আদালত যে রায় দিয়েছে, সেখানে কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। জল্পনা, গুজব, রটনার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। যুক্তিগুলো আদালতের কাছে আমলযোগ্য হয়নি। সে কারণে মামলা খারিজ করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো, বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছিল সেগুলো যুক্তিহীন ছিল। এ অভিযোগের মাধ্যমে সরকার ও দেশের জনগণের ওপর একটা কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়েছিল। এ রায়ের মাধ্যমে আমরা স্বস্তি পেয়েছি। তবে বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর সোশ্যাল এ্যাকাউন্টিবিলিটি (জিপিএসএ) পুরস্কারজয়ী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এটা খুবই সামান্য ব্যাপার যা বেশ দেরিতে হয়েছে। আরও কয়েক মাস আগেই এটা করা উচিত ছিল। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনার পরই তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল।’ কথিত নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক এনজিও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের কিভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাজে প্রভাব ফেলবে এটি। কেননা দাতারা এখন কোন বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়ে আরও সচেতন হবে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেছিলেন, ‘এ ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। সরকার এখনই বিষয়টি নিয়ে না ভাবলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্কট তৈরি হবে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কারণে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। যখনই কোন ঋণদানকারী সংস্থা এ দেশের প্রকল্পে অর্থ প্রদান করবে, তখন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকবে।’ আরেকজন সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, ‘মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রমাণ করে সরকার বিশ্বব্যাংকের তোলা অভিযোগ মেনে নিয়েছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে দুর্নীতি হয়েছে। যদিও বেশ দেরিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা প্রমাণ করছে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে।’ নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রশ্ন তোলেন, “কেন প্রধানমন্ত্রী এমন একজন মানুষকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে প্রচার করবেন। আর কেনইবা সেটা লন্ডন থেকে করতে হচ্ছে। যদি আসলেই মন্ত্রীর সৎসাহস থাকত, তাহলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরপরই সে পদত্যাগ করত।” এদিকে, সে সময় প্রকাশিত এক কলামে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার লেখেন, ‘পদ্মা ব্রিজ নিয়ে হওয়া দুর্নীতির তদন্ত করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যর্থ হয়েছে। যদি দুদক সঠিক কাজটি করত, তাহলে হয়ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের বরাদ্দ বাতিল করত না। দেশ ও জাতির পাশাপাশি উন্নয়ন সহায়ক অংশীদাররাও চায় দুদক তার সঠিক দায়িত্ব পালন করুক।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই একদিন হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে দুই-তিনগুণ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়াসও পিছিয়ে গেল। এখানে মূল দায় যাদেরই হোক, স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদকের কাছে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত দেশবাসীর কাম্য ছিল। এমন আশা করছিল উন্নয়ন সহযোগীরাও। এতে ঋণচুক্তিটি হয়তবা রক্ষা পেত। আইন ও অবয়বে ভিন্ন রূপ নিলেও কাজকর্মে দুদক কিন্তু তার পূর্বসূরি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর ছায়াই অনুসরণ করে চলছে। অথচ কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক মর্যাদাসম্পন্ন। তাদের অপসারণও সুপ্রীমকার্টের বিচারকদের মতো একটি জটিল প্রক্রিয়াসাপেক্ষ। দায়িত্ব পালনে তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সামান্য সময়ের জন্য যেটুকু আইনী জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা-ও অপসারিত। তা সত্ত্বেও সংস্থাটি তার স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার ছাপ রাখতে কিছুমাত্র সক্ষম হয়েছে- এমন দাবি করা যাবে না।’
×