ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লড়াই করে হারল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

লড়াই করে হারল বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ, হায়দরাবাদ থেকে ॥ ভারতের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নামার আগে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম বলেছিলেন, ‘এমন খেলতে চাই, যেন বার বার আমাদের আমন্ত্রণ জানায় ভারত।’ বাংলাদেশ খেললও সে রকমই। লড়াই করল। ম্যাচ না হারার প্রাণপণ চেষ্টা করল। ভারত ক্রিকেটারদের মনের ভেতর ভয় ধরিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত কোহলিদের ভয় ধরানোর পরও বাংলাদেশই হারল। হায়দরাবাদ টেস্টে ২০৮ রানের হার হলো বাংলাদেশের। প্রথম ইনিংসে ভারত আকাশচুম্বি (৬৮৭ রান) রান করায় মনে হচ্ছিল টেস্টটিতে ইনিংস ব্যবধানেই হারতে পারে বাংলাদেশ। ভারতকে আর ব্যাটিংই করতে হবে না। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা বিশেষ করে মুশফিকুর রহীম, সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ দুর্দান্ত ব্যাটিং করলেন। ভুল করে, ভুল শট খেলে মুশফিক, সাকিব আউট হয়েছেন ঠিক, তবে একটি করে যে বড় ইনিংস করেছেন, তাতেই ম্যাচটিতে পাঁচদিন খেলতে পেরেছে বাংলাদেশ। পঞ্চমদিনে গিয়ে চা বিরতির ঠিক আগমুহূর্তে অলআউট হয়েছে বাংলাদেশ। ২৫০ রান করেছে। তা প্রাপ্তির খাতায় স্বাভাবিকভাবেই যোগ হয়ে গেছে। যে দলটির দ্বিতীয় ইনিংসে ভরাডুবি হয় প্রায়ই, সেই দলটি এবার ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে ৪৫৯ রানের টার্গেটে খেলতে নেমেও দ্বিতীয় ইনিংসে দুর্দান্ত করেছে। প্রথম ইনিংসে মুশফিক ১২৭ রান করেছেন। সাকিব ভুল শট খেলে আউট হওয়ার আগে করেছেন ৮২ রান। ৫১ রান করা মেহেদী হাসান মিরাজ অসাধারণ ব্যাটিং করেছেন। তিনি যদি মুশফিককে যোগ্য সঙ্গ দিতে না পারতেন তাহলে প্রথম ইনিংসে দল ৩৮৮ রান করতে পারত না। তাতেও প্রথম ইনিংসে ভারতের চেয়ে ২৯৯ রানে পিছিয়ে থাকে বাংলাদেশ। ফলোঅনেও পড়ে। তখন মনে হয়েছিল বাংলাদেশ আবার দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামবে। কিন্তু ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি সেটি করেননি। নিজেরাই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামেন। তাতে করে চতুর্থদিন দ্বিতীয় সেশনটা পুরো খেলে ভারত। ৪ উইকেট হারিয়ে ১৫৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। বাংলাদেশের সামনে জিততে ৪৫৯ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। এ বিশাল টার্গেটে খেলতে নেমে চতুর্থদিন তৃতীয় সেশন পুরোটা খেলে ৩ উইকেটে ১০৩ রান করে বাংলাদেশ। তামিম অযথা রান আউট হন। সৌম্য শট খেলতে গিয়ে সাজঘরে ফেরেন। আর মুমিনুলও দ্রুতই আউট হলে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। ৭৫ রানেই ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন মাহমুদুল্লাহ ও সাকিব। সাকিব অপরাজিত ২১ ও মাহমুদুল্লাহ অপরাজিত ৯ রান করেন। যদি তামিম, সৌম্য ও মুমিনুলের মধ্যে দুইজন চতুর্থদিন ব্যাটিংয়ে থেকে শেষ করতে পারতেন, তাহলে ভারত ক্রিকেটারদের ভেতর আরও ভয় ঢোকানো যেত। পঞ্চমদিনে কী ঘটবে? বাংলাদেশ দিনটিকে রঙিন করে তুলতে পারবে? নাকি ভরাডুবি হবে? এমন প্রশ্নই চতুর্থদিন শেষে ঘুরপাক খায়। পঞ্চমদিন সকালের সেশনটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই সেশনেই আসলে বাংলাদেশের হেরে যাওয়ার পথ তৈরি হয়ে যায়। এত সুন্দর খেলছিলেন মাহমুদুল্লাহ ও সাকিব, কিন্তু শুরুতেই জাদেজার দুর্দান্ত একটি ঘূর্ণি বলে আউট হয়ে যান সাকিব। এরপর প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান মুশফিক ভুল শট খেলেই সব শেষ করে দেন। অশ্বিনের বলে শট খেলতে গিয়ে ব্যাটে বল ঠিকমতো না লাগায় আউট হন মুশফিক। সেখানেই আসলে বাংলাদেশের হারের পথ তৈরি হয়ে যায়। ১৬২ রানেই ৫ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। প্রথম সেশন শেষ না হতেই সাকিব ও মুশফিক আউট হওয়াতে যেন হার কত দেরিতে হবে, সেই সম্ভাবনাই বেঁচে থাকে। উইকেটে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ছিলেন। মুশফিক আউট হওয়ার সময় অর্ধশতকের কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু ফর্ম তার এতটাই খারাপ যাচ্ছিল যে মুহূর্তেই তিনি আউট হয়ে যেতে পারেন। মাহমুদুল্লাহর পর সাব্বির, মিরাজ, রাব্বি, তাইজুল ও তাসকিনও ছিলেন। কিন্তু মুশফিক যখন আউট হন, তখন পুরো দুটি সেশন থাকে। সঙ্গে জিততে ২৯৭ রানও লাগে। তাই বাকিরা এ রান করে ফেলবেন এমন ভাবনা কারওই মনে আসেনি। তবে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর আশা জাগানিয়া জুটির পর মাহমুদুল্লাহ-মুশফিকের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানো জুটিতে ড্র করার সম্ভাবনা জেগেছিল। এ জন্য উইকেট আঁকড়ে থাকতে হতো। কিন্তু সাকিব ও মুশফিক সেই কাজটিই করতে পারেননি। মাহমুদুল্লাহ ও সাব্বির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একদিক দিয়ে ইশান্ত শর্মার গতি ও বাউন্স, আরেকদিকে অশ্বিন ও জাদেজার স্পিন ঘূর্ণিতে উইকেট বাঁচাতে থাকার চেষ্টাটা কতক্ষণ আর করবেন তারা। তারপরও এ দুইজন এমন মুহূর্তে ষষ্ঠ উইকেটে ৫১ রানের জুটি গড়েছেন। দুইজন মিলে দিনের প্রথম সেশন শেষ করেছেন। কিন্তু ২১৩ রান হতেই বিপত্তি ঘাড়ে চেপে বসে। জেতা সম্ভব নয়। এরপরও মাহমুদুল্লাহ-সাব্বির যখন খেলেছেন, তখন খানিকটা হলেও ড্র করার আলো জ্বলে। কিন্তু ইশান্ত শর্মার এক ‘গুড লেন্থ’ বলেই সব আলো নিভে যায়। ৬০ মিনিট ব্যাটিংয়ে থেকে ৬১ বল খেলে ২২ রান করে ‘রিভিউ’য়ের ফাঁদে পড়ে এলবিডাব্লিউ হয়ে মাঠ ছাড়েন সাব্বির। এতক্ষণে গিয়ে যেন বাংলাদেশের হার সময়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যখন ইশান্তের শর্ট বলেই মাহমুদুল্লাহ অহেতুক পুল করতে গিয়ে ২২৫ রানের সময় ক্যাচ আউট হন, তখন দ্বিতীয় সেশনেই খেলা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা জেগে যায়। সুন্দর খেলছিলেন মাহমুদুল্লাহ। সেই ২০১৫ সালের পর ৯ ইনিংস পর আবার অর্ধশতকেরও দেখা পান মাহমুদুল্লাহ। তিন ঘণ্টা ২০ মিনিট উইকেটে থেকে ১৪৯ বল খেলে ৭ চারে ৬৪ রান করেও ফেলেন তিনি। এমন মুহূর্তেই আশা জাগিয়ে অহেতুক একটা বাজে শটে হতাশায় ডোবান। অবশ্য তিনি উইকেট আঁকড়ে থাকলেও যে বিশেষ কিছু হয়ে যেত তা না। তারপরও এত ভাল ব্যাটিং করার পর অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান যদি এমন বাজে আউট হয়ে যান, তাহলে তা অন্যদের উপর বাজে প্রভাবই ফেলে। প্রথম ইনিংসে সাকিব, দ্বিতীয় ইনিংসে মুশফিকের মতোই বাজে শট খেলে স্বপ্ন শেষ করে দেন মাহমুদুল্লাহ। এরপর তো বোলাররা যেন ব্যাটসম্যান রূপে হাজির হওয়ার চেষ্টা করেন। কামরুল ইসলাম রাব্বি কী দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন। তার কাছ থেকে উইকেটে আঁকড়ে থাকার শিক্ষা যেন নিতে পারেন ব্যাটসম্যানরা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৯২ মিনিট ব্যাট করে ৬৩ বলে মাত্র ২ রান করেছিলেন রাব্বি। ভারতের বিপক্ষে হায়দরাবাদ টেস্টেও দেখালেন ঝলক। ৮৪ মিনিট ব্যাট করে ৭০ বল খেলে করেছেন মাত্র ৩ রান। তাও আবার অপরাজিত ছিলেন। রাব্বি অপরাজিত থাকলেও মিরাজ, তাইজুল ও তাসকিন আর ২৫ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই আউট হয়ে যান। যেই ২৫০ রানের সময় অশ্বিনের বলে তাসকিনের পায়ে লাগে এবং ‘রিভিউ’ নেয় ভারত। থার্ড আম্পায়ার আউট দিতেই বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যায়। হার হয়। তবে লড়াই করেই হারে বাংলাদেশ। কোহলিদের ভয় ধরিয়ে দেয়। এরসঙ্গে পাঁচদিনে যে খেলা গড়ায়, সেটিই এ ‘ঐতিহাসিক’ টেস্টে বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ যে বছর টেস্ট ক্রিকেটের দুনিয়ায় পা রাখে, সেই ২০০০ সালের পর থেকে চতুর্থ ইনিংসে ভারতের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের পর বাংলাদেশই শুধু ২৫০ রান করতে পারে। ১০০ ওভারের বেশি খেলতে পারে। বিশ্বের আর কোন দল পারেনি। এটাওতো বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতায় লেখা থাকছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটের ১৭ বছরে পা রাখার পর ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পেয়ে হায়দরাবাদ টেস্টে কতটা ভাল করেছে বাংলাদেশ। দুই স্পিনার অশ্বিন ও জাদেজা এবং পেসার ইশান্তের দুর্দান্ত বলে ম্যাচটি হেরেছে ঠিক বাংলাদেশ। তবে কোহলিদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। যেটি সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবেই ধরা হচ্ছে।
×