ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু এলাকায় সেনানিবাস নির্মাণ প্রকল্পের ভূমিতে সিন্ডিকেটের তেলেসমাতি

ভুয়া স্থাপনা দেখিয়ে ৬৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভুয়া স্থাপনা দেখিয়ে ৬৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা

আবুল বাশার, শরীয়তপুর থেকে ॥ পদ্মা সেতু এলাকায় সেনানিবাস নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে ভুয়া স্থাপনা ও গাছের বাগান দেখিয়ে সরকারের ৬৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছে শরীয়তপুর জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুধীর কুমার রায়, শরীয়তপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালেহ মুহম্মদ ফিরোজ, প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও এলাকার একটি প্রভাবশালী দালাল চক্র। সোমবার পদ্মা সেতুর জাজিরার পাশে সেনানিবাস নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। সেনানিবাস নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমির উপর নতুন করে নামে-বেনামে ঘর দরজা ও অবকাঠামো নির্মাণ করে এবং ভুয়া গাছের বাগান দেখিয়ে সরকারের প্রায় ৬৩ কোটি টাকা লুটে নেয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এসব দুর্নীতি প্রতিরোধের অনুরোধ জানিয়ে গত ১৮ জানুয়ারি স্থানীয় আবুল কালাম খানসহ একাধিক ব্যক্তি বিষয়টি তদন্তপূর্বক ক্ষতিপূরণের ন্যায্য টাকা পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছে। স্থানীয় ও শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানকল্পে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডের স্থায়ী সেনানিবাস নির্মাণের জন্য পদ্মা সেতু এলাকার জাজিরা পয়েন্টে একটি স্থায়ী সেনানিবাস নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন ২০১৫ সালে। এরপর পদ্মা সেতুর জাজিরা অংশের ল্যান্ডিং পয়েন্টের পূর্ব পাশে ১০১ নং নাওডোবা মৌজায় এল এ ৮ নং কেসের মাধ্যমে ১শ’ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে নতুন করে শত শত অবৈধ ঘর নির্মাণ, গাছপালা লাগানো ও পুকুর খনন করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র। তারা নামে-বেনামে এমনকি জমির মালিক নয় এমন ব্যক্তির নাম দেখিয়ে শরীয়তপুরসহ মাদারীপুর, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে এমন আত্মীয়-স্বজনদের নামে ঘর-দরজা নির্মাণ করে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফসলি জমিতে নতুন করে ভিটা বেঁধে সেখানে সারি সারি ঘর-দরজা তোলা হয়েছে। প্রভাবশালীরা একেক জনের নামে ৩ থেকে ৭টি করে ঘর তুলে ফেলে রেখেছে। বেশিরভাগ ঘরেই তালা ঝুলছে। এছাড়াও জমিতে মেহগনি, কড়ইসহ বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ করে গাছের বাগান তৈরি করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারী টাকা হাতিয়ে নিতেই সামাজিক বনায়নের নামে ফসলি জমিতে বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করেছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুধীর কুমার রায় ও শরীয়তপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালেহ মুহম্মদ ফিরোজসহ প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের মোটা অঙ্কের টাকা উৎকোচ দিয়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ নতুন নির্মিত এসব ঘর-দরজা ও গাছের বাগানের প্রকৃত মূল্য থেকে ২০/২৫ গুণ বেশি মূল্য নির্ধারণ করে এসব স্থাপনা ও বাগানের মালিকদের বিপরীতে বিল প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, জেলা বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেয়ার লক্ষ্যে ১শ’ ৮৫ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করেছে যাদের ঐ প্রকল্পের ভূমিতে থাকা বাগান ও গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। এতে নূর মোহাম্মদ খানের ছেলে বাবুল খানের নামে ৭শ’ ৮০টি মেহগনি গাছ দেখিয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার টাকা, আয়ুব আলী মাদবর ও তার স্ত্রী ফাহিমা বেগমের নামে ৬শ’ ৭০টি মেহগনি, ৪০টি আম ও ২০টি পেয়ারা গাছ দেখিয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা, নান্দু ঢালীর ছেলে সাত্তার ঢালীর নামে একই তালিকায় দুই বার নাম লিখে ৪শ’ মেহগনি ও ২০টি আম গাছ দেখিয়ে ১ কোটি ১৪ টাকা, রজ্জব আলী ঢালীর পুত্র আব্দুর রাজ্জাক ঢালীর নামে ২শ’ ৬০টি মেহগনি, ২০টি নারিকেল, ২২টি জাম, ৪০টি আম, ৪৫টি কাঁঠাল, ১৫টি লেবু, ২৮টি লিচু, ৪০টি আতা ফল, ২০টি কাউ গাছ ও ৫শ’ বাঁশ দেখিয়ে ৯৩ লাখ ১০ হাজার ৫শ’ টাকা, সাত্তার মোল্লার পুত্র নাজমূল মোল্লার নামে ৬৪ লাখ ২০হাজার টাকা হিসেবে প্রত্যেকের নামে বিপরীতে বিল প্রস্তুত করা হয়েছে। এভাবে ১শ’ ৮৫ ব্যক্তির নামে শুধু গাছের বিপরীতেই ২৭ কোটি ৩৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮শ’ (বিধি মোতাবেক ৫০ শতাংশ বর্ধিতাংশসহ) টাকার বিল প্রস্তুত করা হয়েছে, যা সরকারের কোষাগার থেকে দিতে হবে। বাস্তবে বিলের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত গাছপালা ও বাগানের কোন মিল নেই। গাছের বিবরণে যা দেখানো হয়েছে তা শুধু কিছু চারা রোপণ করা ব্যতীত কিছুই না।
×