ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে চারদিনে ৪৬০ কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চট্টগ্রামে চারদিনে ৪৬০ কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ৫০০ কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চট্টগ্রামে মেলার আয়োজন করেছিল রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং সোসাইটি অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। এর মধ্যে মেলার ৪ দিনে বিক্রি হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকার ফ্ল্যাট; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাত্র ৮ শতাংশ কম। রিহ্যাব ফেয়ারের আয়োজকরা জানান, এবারের মেলায় ফ্ল্যাট কেনায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাই এগিয়ে ছিলেন। উচ্চবিত্তরা এখন আর ফ্ল্যাট কিনে না। তাই মধ্যবিত্তদের কথা বিবেচনায় যে সব ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছেÑ সেগুলোই বেশি বিক্রি হয়েছে। মেলায় প্রতিদিনই মধ্যবিত্তদের ভিড় ছিল। আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, প্রথমবারের মতো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গৃহ ঋণ সুবিধা দেয়ায় মেলায় দর্শনার্থী বেড়েছে। এবারের মেলায় ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাটের চাহিদা অনেক দেখা গেছে। গ্রাহকের চাহিদা বিবেচনায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো দুই ও তিন বেডের ৯০০ বর্গফুট থেকে ১৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। সিপিডিএলের ব্যবস্থাপক (সেলস এ্যান্ড মার্কেটিং) আমজাদ হোসেন জানান, ৪০-৬০ লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাটের চাহিদা বেশি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এবং প্রবাসীরা এ ধরনের ফ্ল্যাট কিনছেন। বড় এ্যাপার্টমেন্টের দাম কোটি টাকার বেশি হয় বলে ছোট ও মাঝারি সাইজের ফ্ল্যাট বুকিং দিচ্ছেন তারা। রিহ্যাব চট্টগ্রাম কমিটির প্রেস এ্যান্ড মিডিয়া কমিটির আহ্বায়ক আবদুল গাফফার মিয়াজী বলেন, মেলায় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কম দামে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দেয়ায় বিক্রি বেড়েছে। ক্রেতার পাশাপাশি কোম্পানি ও ব্যাংক লাভবান হয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা কোম্পানিগুলো আবাসন শিল্পের বাজার দখল করেছে বলে প্রতারিত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। ফলে ক্রেতারা এখন সন্তুষ্ট। সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চবিত্তরা নিজেরাই জমি কিনে বাড়ি বানান। তাই ফ্ল্যাট কেনার প্রতি তাদের আগ্রহ নেয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য জমি কিনে বাড়ি করা সম্ভব হয় না। তাই তারাই এখন ফ্ল্যাট কিনছে। মধ্যবিত্তদের হাত ধরেই বাংলাদেশের আবাসন শিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। উচ্চবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট তৈরির মানসিকতা থেকে সরে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের দিকে মনোযোগ দেয়ায় ক্রমেই নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে এ শিল্প। রিহ্যাবের সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রাম রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, ছোট ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হার কমানো এবং সরকারের বেতন স্কেল বাড়ানোর কারণে ক্রেতা বেড়েছে। তিনি বলেন, ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে ঘোষণা সরকার দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে আবাসন খাতে ঋণ সুবিধা আরও বাড়ানো উচিত। গত বছর আবাসন খাতে সরকারের ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা ছিল। চলতি বছর এ খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছি। সরকারের ঋণ সহায়তা বাস্তবায়ন হলে এ খাত আরও শক্তিশালী হবে। রিহ্যাব চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান ও এপিক প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এসএম আবু সুফিয়ান বলেন, দুই বছরে বেশকিছু পরিবর্তন করেছে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। এতে আবাসন খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। এ ধারা আবাসন শিল্পের জন্য পজিটিভ। এতে কোম্পানিগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা হবে এবং ক্রেতারাও ভাল সার্ভিস পাবে; এগিয়ে যাবে আবাসন শিল্প। রিহ্যাবের ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে, এ ৭ বছরে আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে। ২০১৩ সালে আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণ হিসাবে অর্থ ছাড় করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা; যা ২০১২ সালে ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২০১১ সালে মোট ছাড়কৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৫৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা; ২০১০ সালে ১৬ হাজার ২৫১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা; ২০০৯ সালে ১২ হাজার ৩৬৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা; ২০০৮ সালে ১১ হাজার ১০১ কোটি ১১ লাখ টাকা; ২০০৭ সালে ৮ হাজার ৬০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা; ২০০৬ সালে ৬ হাজার ৩৯৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবাসন খাতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের স্থিতি। ২০১২ সালে আবাসন খাতে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৩৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা; যা ২০১১ সালে ২৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা; ২০১০ সালে ছিল ২১ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। আবাসন খাতের বিশেষায়িত সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (এইচবিএফসি) ২০১২ সালে ঋণ স্থিতি ছিল ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা; ২০১০-১১ সালে এই স্থিতি ছিল ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তবে আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ স্থিতি রয়েছে বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। আবাসন খাতে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবাহ থেকে দেখা যায়, ২০১২ সালে এই খাতে ঋণ স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, ২০১১ সালে তা ছিল ১৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা এবং ২০১০ সালে তা ছিল ৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। যা একমাত্র সম্ভব হয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লংকা বাংলা ফিন্যান্স শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ প্রসেসিং ফিতে সাড়ে ১০ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে ২৫ বছর মেয়াদে ৫ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে ৫ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং স্টান্ডার্ড চার্টার্ড সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে ২৫ বছর মেয়াদে সর্বোচ্চ ১ কোটি ২০ লাখ টাকার গৃহ ঋণ দিচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, আবাসন খাতে স্বল্প সুদে আবাসন ঋণ বরাদ্দ দিলে এই শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। উন্নত দেশগুলোতে ৩-৪ শতাংশ সুদে আবাসন ঋণ দেয়। ঋণ মেলে মোট মূল্যের ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর মেয়াদ হয় ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত। এ ঋণে যে মাসিক কিস্তি আসে তা বাসাভাড়ার সমান হয়। ফলে কেউ উপার্জন করতে শুরু করলেই একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে আবাসন খাতে ঋণের ওপর সুদ ১৯ শতাংশ, আর নানা চার্জ আরোপ করে তা গিয়ে ঠেকে ২২ শতাংশে, অন্য সব দেশের তুলনায় এটি বেশি। সরকার একটি রিভলভিং ফান্ড স্বল্প সুদে রাখলেই এ ঋণের প্রকৃত সুফল পাওয়া যেত।
×