ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুযোগ পেলে বাংলাদেশে এসে কাজ করতে চান অরুণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সুযোগ পেলে বাংলাদেশে এসে কাজ করতে  চান অরুণ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ এখন বয়স তার ৪৫। অবিবাহিত! তবু চলমান জীবনেই সন্তুষ্ট তিনি। কানাডার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। জীবনে বন্ধুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। অবসরে তাদের সঙ্গে চলে আড্ডা আর জীবনের গল্পবলা। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আগ্রহ নেই তেমনটা বলা যাবে না। তবুও ঘর সংসার করার প্রতি ঝোঁক নেই। বাবা-মা ভাই বোন নিয়ে বেশ সুখেই আছেন তিনি। কিন্তু তাঁর জীবনে রয়েছে ফেলে আসা করুণ অতীত। সত্যিই চোখে জল আসার মতো ঘটনা। যে পরিবারটিতে দীর্ঘ সময় পার করেছেন তারা তার আপনজন কেউ নন। পালক বাবা-মা। ভাই বোনদের কেউই এই বাবা-মায়ের নন! যে পরিবারটিতে তিনি বেড়ে উঠছেন সেখানে কারও সঙ্গেই নেই রক্তের সম্পর্ক। আত্মীয়-স্বজন কাছের বন্ধু বলেও পৃথিবীজুড়ে কেউ নেই তার। নেই নিজের ধর্মীয় কোন পরিচিতিও। তবুও যেখানে আছেন তিনি শেকড় ভেবেই আছেন। পরিবারের প্রত্যেকে তার আপনের চেয়েও অনেক আপন। রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ। তবুও পরের ঘরে সবাইকে আপন ভেবে বড় হয়েছেন। বলছি অরুণের কথা। পিতৃ-মাতৃপরিচয়হীন অরুণই ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শিশুদের একজন। তার জীবনকাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘ক’ থেকে অতপর...ও অরুণের গল্প। গোপনে এসে অরুণকে আশ্রয়ে জন্ম দিয়ে চলে যান ‘মা’ ॥ পূর্ণগর্ভ মেয়াদ না হবার আগেই ১৯৭২ সালের ২৭ মে ঢাকার মাদার তেরেসা শিশু ভবনে যুদ্ধশিশু ‘ক’ এর জন্ম। জন্মের সময় শিশুটির ওজন ছিল দুই কেজি ৪০০ গ্রাম। তিন মাস বয়সে শিশুটি আরও রোগা হয়ে যায়। তখন ওজন কমে দাঁড়ায় এক কেজি ৮০০ গ্রামে। মূলত অপুষ্টির কারণে শিশুটির এমন দশা হয়েছিল। অন্য যুদ্ধশিশুর মতো একই পরিবেশে তার জন্ম হয়। আশ্রম কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, মা গোপনে এসে অরুণকে অনাথ আশ্রমে প্রসব করেই ওকে রেখে চলে যান। তখন আশ্রমের লোকজন ছেলেটির নাম রাখেন ‘অরুণ’। তার ধর্ম ও জাত সম্পর্কেও কিছু জানার সুযোগ ছিল না। নিজেদের মতো করেই নাম রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে অরুণের মাও কিছু বলে যাননি। জন্মের পর নার্স ও ধাই শিশুটিকে খাওয়া দাওয়া দিয়ে রীতিমতো যতেœ রাখেন। তখন শিশুদের বিকল্প খাবার হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণে গুঁড়া দুধ ও ফলমূল পাওয়া যেত না। আশ্রমে কোন ওষুধপত্রও ছিল না। এ কারণে প্রতিদিন এখানে যেমন শিশুরা জন্মগ্রহণ করছিল তেমনি মৃত্যুবরণও করছিল সমানে। নার্সরা চালের পানি ছাড়া অন্য কোন খাবার শিশুদের খাওয়ানোর জন্য সরবরাহ পেতেন না। অরুণের নাম হলো ‘ক’ ॥ কানাডা পৌঁছানোর পর অরুণের দত্তক বাবা-মা তার নাম বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন। ফেরি দম্পতি সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেটিকে ‘ক’ বলে ডাকবেন তারা। অন্টোরিওর বার্লিংটনে সে যখন বড় হচ্ছিল, ফেরিদের শিশু হিসেবে তাতে অসাধারণ কোন উপাদান ছিল না। এখনও ছেলেবেলার কথা স্পষ্ট মনে আছে অরুণের। মনে পড়ে তার দত্তক নেয়া বাবা-মায়ের সুখ্যাতি ও সুনাম। কমিউনিটির লোকজন তার বাবা-মাকে খুব মানত। ‘ক’ বার্লিংটনে ফেয়ারভিউ এলিমেনটারি স্কুল যেতেন। এরপর ভারতে দু’বছরের জন্য ছিলেন। প্রাথমিক থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত শিক্ষা জীবন বেশ মজার ছিল অরুণের। ওর বাবা-মা ‘ক’ ও ‘খ’ দুই সন্তানকে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুসৌরিতে বোর্ডিং স্কুল ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলে পড়তে পাঠান। তখনও অরুণ দত্তক ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারেননি। তবে তার পরিবার যে বহুজাতিক এটা বুঝতে পেরেছিলেন। ‘ক’ বিশ্বাস করেন বাবা-মায়ের উৎসাহ ছাড়া এত বিষয়ে জড়িত থেকে ভাল করতে পারত না। বাড়িতে চড়ুইভাতি, পুনর্মিলনী, বার্বিকিউ, খেলাধুলা সবকিছুই এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। নিজের সম্পর্কে জানতেন অরুণ ॥ উত্তর ভারতে আসার পর ভারতের এ বিখ্যাত জায়গাটির প্রেমে পড়ে যান অরুণ। বেশ হাসি আনন্দে কাটে এখানকার দিনগুলি। কিন্তু অবসরে নিজের পরিচিতি নিয়েও তিনি প্রায়ই ভাবতেন। তখন মনে উদয় হওয়া অসংখ্য প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজে বেড়াতেন ‘ক’। তবে পরিবারের কাছ থেকে তিনি পুরোপুরি অবগত ছিলন নিজের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে। ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে তার জন্মদাত্রী মা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। তার জন্মের পর পরই সে নিরুপায় ও আশ্রয়হীনা শিশুটিকে পরিত্যাগ করেছিলেন। কিছুদিন পরই তাকে তার কানাডীয় বাবা-মা দত্তকায়নের মাধ্যমে তাকে কানাডায় নিয়ে আসেন। এর চেয়ে বেশি কিছু অরুণ জানার চেষ্টা করেননি। নিজের জন্মপরিচয়সহ অবস্থান নিয়ে অনেক ভাবেন অরুণ। অনেক ভাবনার পর নিজের কাছে মনে হয়েছে, জন্মবৃত্তান্ত যাই হোক না কেন কানাডাই তার বাড়ি। সেখানে সে বড় হয়েছে। কথা বলতে শিখেছে। জীবনের প্রথম যে সাত মাস বাংলাদেশে কেটেছে, এটা ছিল এক চলমান সময়ের অংশ। ‘ক’ ভারত থেকে কানাডা ফেরেন ১৯৮৭ সালে তার হাইস্কুল শেষ করার জন্য। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বার্লিংটন লেস্টার বি পিয়ারসন হাইস্কুলে ভর্তি হন। পরের বছর তিনি অরেঞ্জভিল সেকেন্ডারি স্কুলে গ্রেড-১২তে হাজিরা দিয়ে যান। তবে জন্মপরিচয় নিয়ে যখনই নিজের মনে প্রশ্ন তৈরি হতো তখনই বাবা-মা তাকে সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। কর্মজীবন ॥ ১৭-১৯ বছর বয়সে অরুণ নির্মাণ কাজে জড়িত হন। দুস্থ ও অল্প আয়ের লোকদের বাড়ি তৈরির প্রকল্পে তিনি আট মাস কাজ করেন। পাশাপাশি অন্টোরিও প্রদেশের টিমিনস শহরের কাছে উত্তর কানাডার আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা (সাধারণত ইন্ডিয়ান রিজার্ভ বলে আখ্যায়িত করা হয়) শ্যাপেলোতে কয়েকটি প্রকল্পে তিনি স্বেচ্ছাশ্রম দেয়ার জন্য নাম লেখান। সেখানে মজুরি বলতে খাবারের খরচ মিলত। ১৯৯২ সালে অরুণ অতিথিসেবা বিষয়ে পড়াশোনা করে জীবিকা উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। তারপর বাড়ি ছেড়ে টরেন্টা শহরে যান জর্জ ব্রাউন কলেজে। সেখানে বিভিন্ন রেস্তরাঁয় কাজ করেন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে। কোন পেশায় থাকবেন এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষ ছিল না অরুণের। আবারও নার্সিং নিয়ে পড়াশোনা। বর্তমানে বার্লিংটন শহরে প্রক্রিয়াজাত করার এক কোম্পানিতে কাজ করেন অরুণ। ‘ক’ বলেন, অপার স্নেহ মমতার মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। তাই বাবা-মা ভাই-বোনসহ তাদের ছেলেমেয়ে নিয়েই থাকেন। অরুণের বক্তব্য হলো, ছোটবেলা থেকেই মা বেশি রক্ষণশীলা ছিলেন না। মা সবসময় ‘মুরগি’ যেভাবে তার ছানাদের রক্ষা করে সেরকমও ছিলেন না। তবে শর্তহীন ভালবাসা দিয়ে বাবা-মা বড় করেছেন তাদের এজন্য কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই তার। কারণ সারাজীবন বাবা-মা একের পর এক অনাথ শিশুদের এনে বড় করেছেন। যেসব অনাথ বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী সে ধরনের শিশুদেরও কোলে তুলে নিয়েছেন তাদের বাঁচানোর সুযোগ দেয়ার জন্য। অরুণের সবচেয়ে মজার দিক হলো, বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বহু বাংলাদেশীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। তিনি তাদের পছন্দ করেছেন এ পর্যন্তই। এখন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে আসেননি। তিনি জানান, যদি কখনও সুযোগ হয় আসতে পারেন। এমনও হতে পারে বাংলাদেশে এসে তিনি স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ করতে পারেন। এখনও অবিবাহিত অরুণ ॥ অরুণ নিজে থেকেই জানিয়েছেন এখনও বিয়ে করেননি তিনি। তবে বহু শ্বেতাঙ্গ বন্ধু তার। সবাই নিজে থেকে পরিচিত হয়ে বন্ধুত্ব গড়েছেন। তিনি বলেন, বিয়ের বিষয়ে তড়িঘড়ি করার কিছু নেই। আগে একটি স্থায়ী চাকরি পেতে চান তিনি। তারপর বিয়ের কথা ভাববেন। রসিকতা করে বলেন, এই মুহূর্তে বিয়ের ফাঁস গলায় পরতে তার মন চাইছে না। এখন যে অবস্থায় জীবন চলছে তা মন্দ নাÑ মত দেন তিনি। চলমান জীবনেই সন্তুষ্ট অরুণ। তিনি সব সময় ভাবেন লটারিতে যদি একটি জ্যাকপট জেতা সম্ভব হতো তাহলে নিজের সব ধারদেনা শোধ হয়ে যেত। ১৩ সন্তান ছিল অরুণের বাবা-মায়ের ॥ অরুণের দত্তক নেয়া বাবা-মায়ের নাম ডাঃ রবার্ট ফেরি ও হেলকে ফেরি। ১৯৭২ সালে ডাঃ ফেরি ছিলেন শল্য চিকিৎসক এবং ইউরোলজিস্ট, জোসেফ ব্রান্ট হাসপাতাল, বার্লিংটন, অন্টোরিও, কানাডাতে নিযুক্ত ছিলেন। তার স্ত্রী হেলকে ফেরি মন্ট্রিয়লের আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থা নিয়ে কর্মরত একটি সংস্থার দ্বারা অনুরুদ্ধ হন, তারা ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের (এফএফসি) কিছু বিশেষ কাজের অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। হেলকে ফেরির জন্ম জার্মানিতে। বড় হন ভারতে। ১৯৬৯ সালে হেলকে ও রবার্ট বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হন। সেখানে হেলকে ছিলেন ছাত্রী। রবার্ট শল্যবিদ্যার অধ্যাপক। দু’জন পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন ১৯৭০ সালে। বিবেকবান ছিল এই দম্পতি। তাই তারা ঐতিহ্যবাহী দত্তকপ্রথা বর্জন করে অনাথ শিশুদের এক জায়গায় করার প্রয়াসে ব্রতী হন। যেসব শিশুকে কেউ দত্তক নিতে চান না, যাদের সাধারণত সমাজকর্মী ও সম্ভাব্য দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মা সকলেই এড়িয়ে যেতে চান, তাদের পুনর্বাসন ব্যবস্থাই ছিল এই দম্পতির অতিরিক্ত আগ্রহ। যেহেতু এ ধরনের শিশুদের পাশ কাটানোর, একেবারে সরিয়ে দেবার ঝোঁক ছিল সবার; তাই এই দম্পতি নিজেরাই খুঁজে খুঁজে এই শিশুদের বের করত। ১৯৭২ সালের জুনে বাংলাদেশে এই দম্পতি নিজ খরচে এসে কানাডীয় দলের সঙ্গে ফ্রেড ক্যাপুচিনো ও তার স্ত্রী বনির সঙ্গে যোগ দেন। কানাডীয় জনশক্তি ও অভিবাসন বিভাগ ডাঃ ফেরিকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন যুদ্ধ শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। ঐ যুদ্ধশিশুদের যেহেতু গর্ভকালীন মেয়াদ শেষ হবার আগে জন্ম হয়েছিল এবং বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন ছিল তাই ডাক্তারি পরীক্ষা করে উপযুক্ত শিশুদের নির্বাচন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন ফেরি দম্পতি দুর্বলতম একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে নেয়ার জন্য ঠিক করে। ১৯৭২-৮৫ সাল পর্যন্ত এই দম্পতি ১০ অনাথ শিশুকে দত্তক নিয়েছিল। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে নেয়া মোট ১৩ শিশুকে লালন পালন করেছিলেন। এদের মধ্যে তিন শিশু তাদের ঔরসজাত। ১৯৭২ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে হেলকে নিরলসভাবে বাংলাদেশ থেকে আরও অনাথ শিশু আনার ব্যাপারে কাজ করে যান। অক্টোবরে হেলকে আবার বাংলাদেশে যান। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে। এবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার বেশ কয়েক সদস্যের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাত করেন। তিনি দত্তক বিষয়ে কয়েকটি জরুরী ইস্যুর ওপর অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আলোচনা করেন। রবার্ট ও হেলকে দুজনেই দাবি করেন, এটা একটা নৈতিক কর্তব্য এবং তারা তাই করতে এসেছেন। তখন ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব হেলকে অনাথদের বিষয়ে জ্ঞান ও তাদের জন্য মায়া-মমতা লক্ষ্য করে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
×