ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আগুন লাগা ফাগুনের ডাক, বইয়ের সঙ্গে হবে উদযাপন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আগুন লাগা ফাগুনের ডাক, বইয়ের সঙ্গে হবে উদযাপন

মোরসালিন মিজান ॥ মেলা প্রাঙ্গণের পুরোটাজুড়ে ফুলের বাগান হবে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতো এটিও শুধু প্রতিশ্রুতি হয়ে থেকে গেছে। তাই বলে ফুলের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হয়নি মেলা। গত কয়েক দিন ধরেই খোঁপায় করে ফুল নিয়ে আসছিলেন তরুণীরা। আর রবিবার মেলায় ঢুকে মনে হলো ফুলের সমারোহ! বিভিন্ন বয়সী নারীরা ফুলে শোভিত এসেছিলেন। দেখে নিজের অজান্তে মন গুন গুন করে গেয়ে ওঠেছেÑ নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল/বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল...। হ্যাঁ, একদিন আগেই মেলায় দেখা গেল বসন্তের রূপ। গাঁদা আর হলুদ গ্ল্যাডিওলাস বলছিল, বসন্ত এসে গেছে! প্রিয় ঋতুর আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পরেছিল গোটা মেলায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিনথিয়া বাসন্তী রঙের থ্রিপিস পরে এসেছিলেন। একদিন আগেই বাসন্তী রঙ? কেন? জানতে চাইলে কিছুটা অবাক করে দিয়েই বললেন, বসন্ত তো সেই কবে শুরু হয়ে গেছে! আজ জামা পরেছি। কাল পরবো শাড়ি। আর বই? উত্তর দিলেন সায়মা নামের আরেক তরুণী। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী। বললেন, কালকের দিনটা উদ্যাপন করতেই তো আজ মেলায় এসেছি। তারপর হাতে ধরে রাখা কয়েকটি কবিতার বই দেখিয়ে বললেন, পহেলা ফাল্গুনে বন্ধুকে গিফট করব। অবশ্য পহেলা ফাল্গুনের সবচেয়ে বড় ঢেউটি আজ এসে আচড়ে পরবে গ্রন্থমেলায়। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা বাসন্তী রঙে সেজে মেলায় আসবেন। তাদের আড্ডা গল্প রাগ অনুরাগের সঙ্গী হবে বই। বলার অপেক্ষা রাখে না, দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন লেখক প্রকাশকরাও। আজ বিপুল বিক্রির আশা করছেন তারা। কী ধরনের বই আজ বেশি চাইবেন পাঠক? এমন প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর কারও জানা নেই। তবে এদিন দেখা গেল অধিকাংশ স্টলের সামনেই কবিতার বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দিব্য প্রকাশের স্টলে সাজানানো ছিল আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা, রফিক আজাদের প্রেমের কবিতা। হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ উঁকি দিচ্ছিল। বিদ্যা প্রকাশের স্টলে পাওয়া গেল আবুল হাসানের কবিতা সমগ্র। অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হকের নির্বাচিত ১০০ কবিতা। পাঞ্জেরীর প্যাভিলিয়নেও পাওয়া যাচ্ছে সৈয়দ হকের শেষ জীবনে লেখা কবিতার বই। নালন্দার স্টলে দেখা গেল লিপি শেঠের কাব্যগ্রন্থ ‘ছন্নছাড়া।’ এভাবে বিভিন্ন স্টলে প্রাধান্য পাচ্ছে কবিতার বই। প্রেমিক মন কবিতা নেবে তো আজ? নির্বাচিত বই ॥ মেলার দ্বাদশ দিনে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল ঘুরে পাওয়া গেল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই। বইগুলোর মধ্যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘গল্প পঞ্চাশৎ’ প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। খ্যাতিমান গল্পকারের পঞ্চাশটি গল্প রাখা হয়েছে বইতে। বইটির মূল্য ৫০০ টাকা। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে অনুবাদ গ্রন্থ ‘পিকাসো ক্রিয়েটর এ্যান্ড ডেস্ট্রয়ার।’ বইয়ের মূল লেখক আরিয়ানা হাফিংটন। ১৯৮২ সাল থেকে পিকাসোর ওপর গবেষণা শুরু করেন তিনি। এই গবেষণা ১৯৮৮ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। মূল বইটি থেকে অনুবাদ করেছেন ফিরোজ আহমদ কামাল। উৎস থেকে মেলায় এসেছে ‘গল্পগুচ্ছ প্রভাব ও সংযোগ।’ সম্পাদনা করেছেন প্রশান্ত মৃধা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পাঠ করে তার পরবর্তিত সময়ের ২৩ জন কথাসাহিত্যিক যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, তার বিশ্লেষণ এই গ্রন্থ। মেলায় সময় থেকে এসেছে ‘ফরিদ আহমেদের প্রকাশকনামা ও হুমায়ূন আহমেদ।’ প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের বিগত দিনের রচনা এখনও মেলায় প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। পুরনো অনেক লেখা নতুন করে উপস্থাপন করছেন প্রকাশকরা। তবে সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ নিজেই লিখেছেন। দীর্ঘকাল তিনি হুমায়ূন আহমেদকে কাছে থেকে দেখেছেন। সেই সব স্মৃতির আকর্ষণীয় বর্ণনা পাঠকের ভাল লাগতে পারে। ৯৬ নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গতকাল মেলায় ৯৬টি নতুন বই এসেছে। এগুলোর মধ্যে গল্প ৮, উপন্যাস ২০, প্রবন্ধ ৩, কবিতা ৩৫, শিশুসাহিত্য ৭, নাটক ১, ভ্রমণ ৩, ইতিহাস ১, রাজনীতি ১, রম্য/ধাঁধা ১, অনুবাদ ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর রয়েছে আরও ১৫টি বই। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩২টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে কথাসাহিত্যিক শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘একাত্তর ও অন্যান্য গল্প’ বইটির কথা। অন্যপ্রকাশ থেকে আসা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। এ সময় লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামসহ ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এবারের মেলা শুরু থেকেই জমে উঠেছে। গেল শুক্রবারে তো আমি মানুষের ভিড়ে ভেতরে প্রবশেই করতে পারিনি। পহেলা ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসে বইপ্রেমীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘দীনেশচন্দ্র সেনের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. মাহবুবুল হক এবং ড. এম আবদুল আলীম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। প্রাবন্ধিক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গবেষণা, বাংলা সাহিত্যকে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নের উপযোগী করে গ্রন্থ-প্রণয়নে এবং সকল সংকলন-সম্পাদনার মাধ্যমে পূর্ববাংলার উন্নত লোকসাহিত্যকে বিশ্বপরিম-লে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন দীনেশচন্দ্র সেন। উনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙালির জাতীয় মানসে উপনিবেশবাদী চিন্তার বিপরীতে যে স্বাজাত্যবোধের জাগরণ ও সমৃদ্ধ অতীতের গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রবল স্পৃহা সৃষ্টি হয় তা থেকেই পরিপুষ্ট লাভ করে দীনেশচন্দ্র সেনের জীবনবোধ। অপরিসীম সাহিত্যানুরাগী ও দেশকল্যাণব্রতী দীনেশচন্দ্র সেন জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পদৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিলেন আধুনিক ও আবেগময়, জাতীয়তাবোধ ও বিশ্বাত্মবোধপুষ্ট এবং আভিজাত্যের গৌরববিযুক্ত নি¤œবর্গমুখী ও সদর্থক জীবনচেতনার উদ্দীপ্ত। সাহিত্যচর্চায় তার সাধকোচিত নিষ্ঠাই তাকে জাতীয় ঐতিহ্য আবিষ্কার ও ইতিহাসের সত্য-উন্মোচনে সার্থক করে তুলেছে। আলোচকরা বলেন, গীতিকা সাহিত্য সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনায় দীনেশচন্দ্র সেন যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা অনন্য। সেই সঙ্গে গীতিকাসমূহের শিল্পগুণ মূল্যায়নেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর আমরা পাই। উদার, অসাম্প্রদায়িক ও বস্তুনিষ্ঠ প্রতিভার বলেই তিনি জাতীয় সীমারেখা অতিক্রম করে বৈশ্বিক পরিম-লে পরিচিতি পেয়েছেন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন রেজিনা ওয়ালী লীনা, রফিকুল ইসলাম, এম মাহিদুল ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন নিপু। সঙ্গীত পরিবেশন করেন স্বপ্না রায়, চন্দনা মজুমদার, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, মো. নূরুল ইসলাম এবং রহিমা খাতুন।
×