ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...

মোরসালিন মিজান ॥ আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মতো...। লাগলো কি প্রাণে সেই বাতাস? বসন্তের বাতাসটুকু প্রাণেই লাগে বেশি! টের পাওয়া যাচ্ছে? চেনা যাচ্ছে হাওয়াটা? না চিনলেও ক্ষতি নেই। কবিগুরু বলছেন- যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে/এই নব ফাল্গুনের দিনে...। সেই বুক ধুকপুক, সেই শিহরণ জাগানিয়া ফাগুন এসেছে। কানে বাজছে স্বাগত সঙ্গীত- আজি দখিন-দুয়ার খোলা-/ এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো...। ফাগুনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এসেছে বসন্ত। আজ সোমবার ১ ফাল্গুন ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। কবিগুরুর ভাষায়- বসন্ত, দাও আনি,/ফুল জাগাবার বাণী-/ তোমার আশায় পাতায় পাতায় চলিতেছে কানাকানি...। প্রেমের কবি নজরুলের উচ্চারণ- এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন...। লোক কবি শাহ আব্দুল করিমকেও উতলা করে দেয় বসন্ত। ভাটি বাংলার সাধক পুরুষ গেয়ে উঠেন- বসন্ত বাতাসে সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। প্রতিবারের মতোই রাঙিয়ে দিতে এসেছে ফাগুন। শূন্য হৃদয় ভরিয়ে দিতে এসেছে। মনের গহীন কোণে অতি সূক্ষ্ম যে পুলক, সে তো কেবল বসন্তই জাগাতে পারে! এই বসন্ত কুসুম কোমল প্রেমের। কাছে আসার। প্রিয়জনের স্পর্শ নিয়ে বাঁচার সুখ বসন্ত। আজ প্রথম দিবসে নগরজুড়ে থাকবে উৎসব অনুষ্ঠান। প্রিয় ঋতুকে বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেবে বাঙালী। নিজস্ব সংস্কৃতির মহা উৎসবে যোগ দেবে সব ধর্ম বর্ণ মত পথের মানুষ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ প্রতি দুই মাস অন্তর রূপ পরিবর্তন করে। শুরু হয় গ্রীষ্ম দিয়ে। বসন্ত দিয়ে শেষ। বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী এই বসন্ত। এখন বনে যেমন, মনেও এর আশ্চর্য দোলা। এরই মাঝে রূপ লাবণ্যে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। বৃক্ষের নবীন পাতায় আলোর নাচন। ফুলে ফুলে বাগান ভরে উঠেছে। চোখ খুললেই গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের হাসি। মৌমাছির গুঞ্জন। কোকিলের কুহুতান। সব, সবই বসন্তকে আবাহন করছে। জানিয়ে দিচ্ছে- আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। ফাগুনের এই ক্ষণে বিবর্ণ প্রকৃতি জেগে উঠেছে নতুন করে। বাগানে বাগানে ফুটছে কুসুম। শিমুল, কাঞ্চন, মাধবী, কৃষ্ণচূড়ায় সেজেছে বন। কবিগুরু সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন- ওরে ভাই, ফাগুন এসেছে বনে বনেÑ/ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,/আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে...। শুধু পাতা আর ফুলেরা কেন? আপন মনে গাইছে পাখি। কত কত গান! কবিগুরুর বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে বললে- আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...। অথবাÑ বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি,/ দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি ...। বনের মতোই অনাদিকাল ধরে বাঙালীর মন রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বসন্ত। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অন্য সব অনুষঙ্গ ভুলে যান। অদ্ভুত সুন্দর তার বলাটিÑ ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত...। এই বসন্তে ভীষণ আকুলি বিকুলি করে ওঠে মন। বুকে নতুন করে জাগে ভালবাসার বোধ। কবিগুরুর ভাষায়- আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।/ সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে—/ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত...। আর বিখ্যাত সেই স্বীকারোক্তি তো সবার জানা, যেখানে কবিগুরু বলছেন- ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল...। হ্যাঁ বসন্ত এমনই। সারা বছর বলতে না পারা মনের গোপন কথাটিও ফাগুনের প্রথম দিনে প্রিয়জনকে বলে দেয়া যায়। অনেকেই ‘ভালোবাসি’ বলার জন্য বিশেষ এই দিবসটিকে বেছে নেন। ভাললাগা ভালবাসার সৌরভ ছড়ানো ছাড়াও মিলনের বার্তা দেয় বসন্ত। এমন লগ্নে প্রিয়জনের কাছে দেহ-মন সঁপে দিতে যেন বাধা নেই কোন। ভীরু প্রাণে কেবলই বাজে- মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/ মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে...। লোকজ সুরেও প্রতিধ্বনি হয় অভিন্ন বাসনা। আব্বাস উদ্দীনের কালজয়ী কণ্ঠ শোনায়- সুখ বসন্ত দিলরে দেখা, আর তো যৈবন যায় না রাখা গো...। এভাবে বসন্তের আগমনে উচাটন হয়ে ওঠে মন। পুরনো বেদনা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ভালবেসে এর পেছনে আবারও ছুটতে প্ররোচনা দেয়। পাখিরাও প্রণয়ী খোঁজে এ সময়। ঘর বাঁধে। মৌমাছিরা মধুর খোঁজে হন্যে হয়। এক ফুল থেকে ছোটে অন্য ফুলে। আর যারা বসন্তেও বাঁধে না ঘর, বাঁধতে পারে না যারা, তাঁদের বেদনা গাঢ় হয়। কবিগুরুর সেই বেদনার কথা উল্লেখ করে লেখেন- মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান/ ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...। অন্যত্র তিনি লেখেন- অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-/দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে...। সব মিলিয়ে অনন্য ঋতু বসন্ত। প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নিতে আজ সারাদেশেই থাকবে নানা উৎসব অনুষ্ঠান। রাজধানী ঢাকার অলিগলি রাজপথে ভিড় বাড়বে। রঙিন হয়ে উঠবে চারপাশ। সকাল হতেই বাসন্তী রং শাড়ি পরে বেরিয়ে পড়বে তরুণীরা। ছোট্ট মেয়েটিও খোঁপায় জড়িয়ে নেবে গাঁদা ফুল। বড়দের মতো শাড়ি পরে গন্তব্যহীন হেঁটে যাবে। ছেলেরা পরবে পাঞ্জাবি। দল বেঁধে ঘুরে বেড়াবে। দিনটি বিশেষত প্রেমিক প্রেমিকাদের। যুগল স্রোতে ভেসে উদ্যাপন করবে চিরসুখীজন। এভাবে গোটা শহরে পৌঁছে যাবে বসন্তের বার্তা। যথারীতি মানুষের ঢল নামবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলার বকুল তলাসহ আশপাশের এলাকায়। বসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়বে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বইয়ের মেলা হয়ে উঠবে বাঙালী সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য উৎসব। রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যানের সবুজের সঙ্গে আজ হলুদ রংটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, রেস্তরাঁ সবখানে পরিলক্ষিত হবে উৎসবের রং। উচ্ছ্বল ছোটাছুটি। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ থাকছে বেশ কিছু উৎসব অনুষ্ঠান। গত ২২ বছরের ধারাবাহিকতায় বসন্ত উৎসব আয়োজন করবে বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। আজ সোমবার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হবে। উৎসব একযোগে চলবে পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক, ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর এবং উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে। একই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় শুরু হবে বসন্ত উৎসব। ‘জাগাও প্রাণ, প্রকৃতিগান এই ফাগুনে’ আহ্বানে উৎসবের আয়োজন করছে সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গণ। উৎসব উদ্বোধন করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে কলা ভবনের সামনে থেকে একটি প্রকৃতিমঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হবে। পরে মঞ্চে শুরু হবে মূল উৎসব। প্রথমেই থাকবে বাফার শিল্পীদের যন্ত্রসঙ্গীতের পরিবেশনা। আদিবাসী নৃত্য পরিবেশন করবে হেংগরং শিল্পীগোষ্ঠী। সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী কফিল আহমেদ, কাজী কৃষ্ণকলি ইসলাম, গানের দল লীলা, জলের গান, সহজিয়া। সবশেষে থাকবে সমগীত গানের দলের পরিবেশনা।
×