ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভালবাসি ভালবাসি এই সুরে...

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভালবাসি ভালবাসি এই সুরে...

ভালবাসা। ছোট্ট একটি শব্দ। এই একটি শব্দই বেঁধে রেখেছে সবাইকে। আমাদের সব সম্পর্ক ভালবাসার ভিত্তির উপর গড়া। ছোট্ট এই শব্দটিই তার শক্তিবলে যে কোন সম্পর্ককে করেছে কাছাকাছি। একে অপরের কাছে থাকার, কাছে রাখার এই আকুলতার পেছনে রয়েছে ভালবাসা। মাত্র চার অক্ষরের একটি শব্দ। কিন্তু কি এক জাদু, কি এক মায়ামন্ত্রজালে সবাইকে বেঁধে রাখার এক অসীম শক্তি। যার জন্য তৈরি হয় অমর কাব্যগাথা। যার জন্য তৈরি হয় তাজমহল। যার জন্য মানুষ পাড়ি দেয় তপ্ত সাহারার বুক। যার জন্য সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিতেও দ্বিধা নেই কারও। জীবনে চলার পথে মানুষ ভালবাসে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, নিজের সন্তানসহ মানুষকে। সব ভালবাসারই রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য, রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। তবে ভালবাসা শব্দটা শুনলেই তরুণ মনে ভেসে ওঠে প্রিয়/প্রিয়ার কথা। বাবা-মা, পরিবার, সন্তান, দেশ, এসব ছাপিয়ে কেন যেন মনের জানালায় উঁকি দেয় প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য হৃদয়ের আকুলতা। ভালবাসা কারে কয় মানুষ ভালবাসার বোধ নিয়েই জন্মায়। ভালবাসা হচ্ছে ভেতরের টান, কোমল ব্যাকুলতা ও আনন্দ। ভালবাসা বহু আয়তনে ভরা। সন্তানের প্রতি স্নেহ, বন্ধুর প্রতি অনুরাগ, প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা, জীবনের প্রতি প্রেম-এ সবই ভালবাসা। ভালবাসা কী? প্রশ্ন করলে হয়ত কোন সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। ভালবাসা আর ভাললাগা এক না হলেও ভাললাগা থেকেই যে ভালবাসার জন্ম এতে কারো দ্বিমত নেই। প্রথমে ভাললাগা তারপরে... কারও চোখ, কারও মুখ ভাল লাগে, আবার কেউবা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’য় মত্ত হন। ভালবাসার ক্ষেত্রে প্রথম দর্শনে ভাল লাগার ব্যাপারটি সব সময় না ঘটলেও ভাল লাগার মানুষটির কোন একটি বিশেষ দিক বা মুহূর্ত সব সময়ের জন্যই ভাল লাগে। কারণ প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা মনোদৈহিক বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই কারও মিষ্টি হাসি দেখে মন হারিয়ে যায়। ভালবাসি থেকে আই লাভ ইউ প্রেম বা ভালবাসা যাই বলি না কেন, আসলে তা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তবু প্রেম শুনলেই মন কেমন করে ওঠে। একটু নাক সিঁটকানো ভাব, একটু দূরে ঠেলে দেয়া। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ প্রেম শুনতে রাজি না হলেও ভালবাসার ব্যাপারে গররাজি। এই তো কয়েক বছর আগেও ছেলেমেয়েরা প্রেম করত লুকিয়ে, আড়াল রেখে। যেন প্রেমের মতো অপরাধ আর নেই; এখন সে ভয় নেই। আজ প্রেমের ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই সাহসী। আগের প্রেমিক- প্রেমিকা নয়, তারা এখন বয়ফেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড। প্রেমেতে সুফল নাথিং প্রেমেতে সুফল নাথিং। এ বুলি এখন অচল। বুট খেয়ে নোট নিয়ে গুডবাই বলার দিন শেষ। এখন প্রেমিকা যেমন শুধু বুট খেয়ে সন্তুষ্ট নয় তেমনি প্রেমিকও শুধু বুট খাইয়ে, নোট দিয়ে খুশি নয়। উভয়পক্ষে বেড়েছে চাহিদার পরিমাণ। আনুপাতিক হারে বেড়েছে বিনিময় হার। বুট, বাদাম সেকেলের কথা। যখন দু’টাকার বাদাম কিনে প্রেমিক- প্রেমিকা পার্কে, ক্যাম্পাসে, গাছের ছায়ায় সারাদিন কাটিয়ে দিত। এমনটি এখন হবার নয়। এ শুধু পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় খুঁজে পাওয়া যাবে। বাদাম, চানাচুর এখন জাদুঘরে, তার স্থান নিয়েছে ক্যাপ্টেন্স, এ্যাবাকাস, কেএফসি, বিএফসি, কুপার্স, চিয়ার্স, ডিঙ্গির মতো অভিজাত নাম। এখন প্রেমিকাকে মাসে একবার ফ্যান্টাসি কিংডম, ওয়ান্ডারল্যান্ড, বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে না নিলে তার মান ভাঙ্গানো কঠিন। ভার্সিটিতে সারাদিনের ক্লাস, এ্যাসাইনমেন্ট, নোট, লাইব্রেরী ওয়ার্ক, গ্রুপ স্টাডি; এগুলোই বাড়ির বাধা দূর করে দেয়। তাছাড়া ক্লাস, লাইব্রেরীতে তো ফোন রিসিভ করা পাবলিক নুইসেন্সের পর্যায়ে পড়ে; অতত্রব নো চিন্তা। সারাদিন ফোন রিসিভ না করলেই হলো। করলেও সমস্যা নেই। কারণ মুঠোফোনের কল্যাণে ‘যা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, তাহাই সোনার বাংলা।’ কখনও মধুর কখনও বেদনাবিধূর টিএসসি, পাবলিক লাইব্রেরী, কেএফসি কিংবা লং ড্রাইভে বহুদূরে হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোতে কোনদিনই মনে হয়নি এর মধ্যে কোন ফাঁক আছে। মনে হয়েছে সর্বত্রই আছে ভালবাসার কোমল স্পর্শ। জন্মদিনের বিশেষ ক্ষণে দামী উপহারের ভিড়ে ভালবাসা চলেছে অকৃত্রিম সৌন্দর্য নিয়ে। হঠাৎ কি এমন হলো? এক সময় চেনা মানুষটিও হয়ে গেল অচেনা। আচার-ব্যবহার থেকে শুরু করে সব কিছুই। প্রশ্নের উত্তরে থাকে নানান বানানো গল্প আর মিথ্যা দোষারোপের ফুলঝুরি। বোঝা যায় সে আর আগের মতো নেই। কোথাও আর আগের মতো পাওয়া যায় না তাকে। না ফোনে, না নেটে কিংবা ফেসবুকে। অন্য এক স্টেটাস, অন্য এক উপলব্ধিতে গুঁড়িয়ে যায় সব স্বপ্ন। শুরু হয় স্বপ্ন ভাঙ্গনের মাতম। দেখা যায়, নতুন এক সঙ্গীর সঙ্গে তাকে নতুনরূপে, নতুন সাজে, নতুন এক ভালবাসার যাত্রায়। খসে পড়ছে আব্রু ভেঙ্গে যাচ্ছে বিশ্বাস ভেঙ্গে যাচ্ছে যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারের আবহ যেমন খুঁজে পাওয়া কঠিন তেমনি এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে আমাদের মূল্যবোধ। আমাদের আব্রু, আমাদের বিশ্বাস। নদীর একূল ভেঙ্গে ওকূল গড়ার মতোই প্রতিনিয়ত ভাঙছে সম্পর্ক, আবার পরমুহূর্তেই গড়ে উঠছে নতুন সম্পর্ক। কাছে থাকার আকুলতার পর মানুষ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সম্পর্কের সেতু তৈরির আগেই তার ভিত নড়ে যাচ্ছে। মুঠোফোনের কল্যাণে ড্রয়িং রুম থেকে বেডরুমে চলে এসেছে বিশ্ব। কথার জাল বুনে প্রেমিক হদয় সাঁতরে ফিরতে চায় আজানা বন্দরে। আর তখনই খসে পড়ে আমাদের আব্রু। তখনই ভেঙ্গে পড়ে সম্পর্কের ভিত। আমাদের আব্রম্ন, আমাদের বিশ্বাস। হয়ত এটাই সত্য, হয়ত নয়। তবুও স্বপ্ন দেখে মন তবু আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দর আগামীর। দিনবদলের। সামনে এগিয়ে যাবার। যান্ত্রিকতার এই যুগে কর্পোরেট কালচারের জোয়ারে পৃথিবীর দূরত্ব কমছে, বাড়ছে ভালবাসার পরিধি। বাড়ছে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি। ভালবাসা এই একটি শব্দই পারে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ফিরিয়ে এনে আমাদের সম্পর্কের সেতুগুলো আরো দৃঢ় করতে। আর তাহলেই মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ কমে যাবে। কমে যাবে যুদ্ধের ভয়াবহতা, অসহায় মানুষ আর যুদ্ধাহত শিশুর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠবে না আধুনিক পৃথিবীর বাতাস। মডেল : তারিন ও উজ্জ্বল ছবি : তানভির হোসেন
×