ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুশো তাহের

পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ও গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ও গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা

আশির দশকের কথা। পত্রিকার আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি সংবাদ পড়ে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উনি একটু সময় নিয়ে বললেন, আমি তো বাবা অত বুঝি না। তবে এ সংবাদ সত্য নাও হতে পারে। আমার পড়া ওই সংবাদের শিরোনাম হলোÑ ‘সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানে শস্যক্ষেত ও মসজিদ ধ্বংস করছে’। বাবার নিকট স্পষ্ট উত্তর না পেয়ে খানিকটা হতাশ হয়ে ভাবতে লাগলাম কার কাছে এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে সোভিয়েত সৈন্যদের এহেন ধ্বংসযজ্ঞের খবরে আহতও হয়েছিলাম। পরে যখন এর বিশদ ব্যাখ্যা পেলাম, তখন জানতে পারলাম স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’র সার্বিক তত্ত্বাবধানে তাদের ভাষায় স্বাধীনতাকামী মুজাহিদদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দিয়েছিল। আর এ কাজে পেট্র্রোডলার যোগান দিয়েছিল সৌদি আরব। বস্তুত এটা ছিল সমাজবাদী দুনিয়ার বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী বিশ্বের যুদ্ধের একটি উইং মাত্র। যুদ্ধের আরেকটি উইং হলো মিডিয়াওয়ার। আর এর মাধ্যমেই মার্কিনীরা চরম মিথ্যাচারকে সংবাদ হিসেবে খাইয়েছিল। এতে কাজও হয়েছিল। এ ধরনের ভুল বার্তার কারণেই শান্তশিষ্ট যুবকরাও উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে সেভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনেক ঘটনাও ঘটেছে। মার্কিনীদের সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো, পশ্চিম মিডিয়ার গোয়েবলসীয় প্রচারণায় বা মিডিয়াওয়ারে তাদের কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। এদিকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অভিযোগ ছিল, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্ব তথা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু এ মতপ্রকাশে স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতা, সততা ও জনগণকে সঠিক তথ্য জানানোর পরিবর্তে যদি বিশেষ কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের মতলব থাকে, তাহলেই বিপদ। কারণ, এর মাধ্যমে জনগণকে বোকা বানানো যায়। কারও বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা যায়, উত্তেজিত করা যায়। যার ফলে জনমানসে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এর বিস্ফোরণে গণতান্ত্রিক সরকারও ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। বাংলাদেশের রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে গোয়েবলসীয় স্টাইলে তথ্য খাওয়ানোর অপপ্রয়াস চালাচ্ছে কতিপয় মিডিয়া। এক্ষেত্রে কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের বিশেষ ওই মিডিয়ার বাড়তি সুবিধা হচ্ছে মিডিয়াকর্মী ও তথ্য নিয়ে গবেষক ব্যতীত অন্যরা সাধারণত একাধিক মিডিয়া উৎস ব্যবহারে কোন তথ্যের সত্যতা যাচাই করেন না। তাদের ভাববার অবকাশ বা প্রয়োজনও নেই যে, কেন বিশেষ ওই মিডিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ ছাপাবে এমনকি ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প : স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক করবে। যেখানে অন্যসব মিডিয়া এ নিয়ে তেমন কোন সংবাদই প্রকাশ করছে না। বিশেষ ওই মিডিয়া অভিনব কৌশলে রূপপুর নিয়ে মিথ্যা সব তথ্য প্রচারে ব্রতী হয়েছে। যেমন গোলটেবিল বৈঠকের সূচনায় সঞ্চালক দাবি করলেন, ‘আমরা দলনিরপেক্ষ। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করার কোন মনোভাব, চিন্তা আমাদের নেই।’ কিন্তু বাস্তবে চারজন আলোচকের বক্তব্য দিয়ে ভরা ওই ক্রোড়পত্রে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র সম্পর্কে মিথ্যার পসরা সাজানো হয়েছে। ওই ক্রোড়পত্রে দেখা যায়, জনৈক বিশেষজ্ঞ বললেন, ‘আমাদের সব সময়ই আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়া নিয়ে যাবে। স্পেন্ট ফুয়েল হলো একটি জিনিস আর পারমাণবিক বর্জ্য হলো আরেকটি জিনিস।’ এক্ষেত্রে হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়টি অতি সরলীকরণের মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে বৈকি। ওই বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাইট লাইসেন্স প্রদান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের রেগুলেটরি বডি সাইট লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। এটা কি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে? নাকি সরকার বলছে তোমরা সাইট লাইসেন্স দাও, দিয়ে দিয়েছে।’ বস্তুত, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি ও কার্যক্রমের যথার্থতা সম্পর্কে ওই বিশেষজ্ঞের অজ্ঞতাই প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে হাইলি টেকনিক্যাল কর্মযজ্ঞে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারকে অযাচিত হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পুরো কাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, যা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ ধরনের মিথ্যা তথ্য জনগণের মাঝে পৌঁছে দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ও উৎপাদনের বিরোধিতাকেই উস্কে দিচ্ছে কথিত প্রচার সংখ্যা শীর্ষের ওই মিডিয়া, যা প্রকারান্তরে উন্নয়নের গণতন্ত্রের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরোধিতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে বাংলাদেশের দুর্বারগতিতে এগিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে গভীর এক ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ পরিচালিত হোক এটা অবশ্যই বাংলাদেশবিরোধীদের পছন্দের নয়। শুধু তাই নয়, বিষয়টি তাদের গাত্রদাহের কারণও বটে। ফলে ওই গোষ্ঠীর এজেন্ডা হতে পারে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ঠেকানো। আর এজন্যই তারা বেছে নিয়েছে দেশের বিদ্যুতখাতে স্বয়ংসস্পূর্ণতা অর্জনকে যে কোন উপায়ে থামিয়ে দেয়া। প্রশ্ন আসতে পারে, ষড়যন্ত্রকারীরা বিদ্যুত খাত, বিশেষত রূপপুরকে কেন বেছে নিয়েছে? আসলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপায়ে বিদ্যুতপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের ঘোষণাও ইতোমধ্যে দিয়েছেন। তাই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে পারমাণবিক অপশন গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের বিদ্যুত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের এক পূর্বাভাস বৈকি। এদিকে মানবতাবিরোধী শীর্ষ অপরাধীদের বিচার সম্পন্নসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা সেক্টরে সফল শেখ হাসিনার সরকার বিদ্যুতখাতে নতুন যুগে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের যুগে প্রবেশকে শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ এমনকি বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র সম্পর্কে আজগুবি সব প্রশ্ন উত্থাপন করে। আমি মনে করি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে বিশেষ ওই মিডিয়ার দায়িত্বহীন প্রচারণা চলছে, যা ভীতি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এর অবসান হওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে সরবারের শীর্ষপর্যায়সহ তথ্য মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিশেষত রূপপুর সেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র সম্পর্কে অমূলক ভীতি ও বিভ্রান্তি দূরীকরণে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশনায় সর্তকতা ও দায়িত্বশীলতার ওপর গুরুত্বারোপে নীতিমালাও করা যেতে পারে। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক
×