ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

সামনে যাই থাক নির্বাচন হবেই

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সামনে যাই থাক নির্বাচন হবেই

বাংলার মাটি হয়ত অনেক কিছুরই দুর্জয় ঘাঁটি। দুর্ভাগ্যক্রমে এই ‘অনেক কিছু’র মধ্যে হরতাল-অবরোধ নামক জরাজীর্ণ বিষয়টিও রয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দেয় নেতিবাচক প্রবণতায় সবকিছুর বিরোধিতার সুর। বাংলাভাষার সেই প্রবাদ ‘বিচার মানি, কিন্তু তাল গাছটা আমার’ নীতিতে বিশ্বাসীর কাছে সব আলোচনা, সিদ্ধান্ত ফ্যাকাসে হয়ে যায় বলেই যৌক্তিক রাজনৈতিক চিন্তার পরিচয় আর দিতে পারে না। প্রতিবাদের ভাষাকে অহেতুক ব্যবহারে ব্যবহারে ক্লিশে করার কাজটিও সম্পন্ন হয়েছে এই দুর্জয় ঘাঁটিতে। ধার ও ভার কমে আসার ফলে তারা নিজেদের জাহির করার আর অমোঘ অস্ত্র খুঁজে পাচ্ছেন না। পেট্রোলবোমা মেরে জীবন্ত মানুষ হত্যা, গুপ্তহত্যা, সর্বোপরি জঙ্গীবাদকে মদদদান গণমুখী কোন কর্মসূচী নয়। রাজনৈতিক দল এ ধরনের কর্মসূচী যখন গ্রহণ করে, তখন বুঝে নিতে হয়, অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য গণবিরোধী অবস্থানে উপনীত হয়েছে। তাদের প্রতিবাদ জনগণের জন্য বলা হলেও বাস্তবে তা হয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে। বিশশতকের রাজনৈতিক ধারা যে বহু আগেই বিগত হয়ে পড়েছে, সন্ত্রাসবাদের ধারকরা তা উপলব্ধি করতে পারছেন না বলেই, পথহারা পথিকের মতো ভ্রান্তির অলিগলিতে হাতড়ে খোঁজে বেরোবার পথ। কিন্তু সে পথে তো তারা নিজেরাই কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে আগে। দলীয় স্বার্থ আর মানুষের স্বার্থের মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। আর এই ফারাক বিরোধী মতামতের মাধ্যমেই উপরে উঠে আসে। কোথায় কী অন্যায় বা দাবি বা ভ্রান্তি থেকে যাচ্ছে তা যদি এই ভাবে উচ্চতর স্তরে উঠে না আসে তবে অন্যায়Ñদাবি ভ্রান্তি বাড়তে বাড়তে জনসমর্থনের ভিতের মধ্যেই ঘুণ ধরিয়ে দেবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে সন্ত্রাসবাদ বিশ্বাসীরা হয়ত জানতেই পারবেন না, ঘুণটি কোথায় ধরেছে, আদৌ ধরেছে কিনা। দশ বছর ধরে ক্ষমতা থেকে, সংসদ থেকে দূরে থাকার কারণে এভাবেই ঘুণাক্রান্ত দলীয় সংগঠন, দলীয় সমর্থন। দলীয় রাজনীতি ভিতর থেকে চুর চুর হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের স্পর্ধা এভাবেই শিকড় উপড়ে দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে এবং নানা কুপ্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকার মাসুল হিসেবে। তদপুরি তাদের অহঙ্কার; মানুষের ভাষা বুঝতে না পারা, ক্ষমতার মোহগ্রস্ততা চোরাবালিতে আটকে রেখেছে রাজনৈতিক দলটিকে। নিজেদের চৈতন্যের প্রবাহে স্ববিরোধের চোরাস্রোতগুলোকে তারা চিহ্নিত করতে পারে নি আজও। যেদিন চিহ্নিত করতে পারবে এবং যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টাই কোন দিন করেনি, সেগুলোর উত্তর খুঁজে পাবে। নিজেদের কালো মেঘে ছাওয়া অর্ধেক আকাশকে সেই দিন অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে পারবে। আরও বোধসম্পন্ন হলে পুরো আকাশই ঝকঝকে হয়ে উঠবে। কিন্তু মাথার উপর যে খোলা আকাশ তার পুরোটা তাদের জন্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দেশসেবা, মানবসেবা উচ্চকিত মন্ত্রোচ্চারণ তারা করে না বরং মানুষকে এখনও দাস, প্রজা ইত্যকারভাবে মর্যাদা দেয়। যে কারণে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট ‘অপারেশন ক্লিনজিং’-এ নেমে নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার মাত্রা বাড়িয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারে এসে সেসব ঘটনার তদন্ত করেছে। তদন্ত রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হলেও কোন অপরাধেরই বিচার হয়নি। কেন হয়নি তার ব্যাখ্যা শাসকদল দিলেও জনমন সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই দশম সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে হরতাল-অবরোধ ডেকে পেট্রোলবোমা মেরে দেড় শতাধিক জীবন্ত মানুষকে হত্যা করলেও সেসব বিচার ঝুলে আছে। পেট্রোলবোমা যারা মেরেছে, মারার উপকরণ সরবরাহ ও অর্থকড়ি প্রদান করেছে, তারা ‘ক্রিমিনাল’ বা অপরাধী। মামলা হলেও বিচারের গতি শ্লথ। প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, গণআদালতে এদের বিচার হবে। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে জনগণই শাস্তি দেবে। কিন্তু বিএনপি মনে করে, তাদের এই বোমাবাজরা পূত-পবিত্র। তাই আটক বোমাবাজ ও সন্ত্রাসীদের মুক্তির দাবি জানায়। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এসব দাগি আসামিদের মুক্তির দাবিতে বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতেও পারে স্বভাবচরিত্র অনুযায়ী। বিএনপির যারা কারাগারে; তারা কেউ রাজনৈতিক কারণে আটক হননি। পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করার অভিযোগে তারা কারারুদ্ধ হয়েছে। এটা বাস্তবিক যে, বিশ্বে রাজনৈতিক কারণে জেলে যাওয়ার নিদর্শন প্রচুর। সেসব গৌরবের সঙ্গে স্মরিত হয়। যে কোন গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের চোখেই এই বন্দিত্ব সম্মানের। কিন্তু বোমাবাজরা নিন্দিত বলেই বিচারের সম্মুখীন। নিজের যুক্তিতে আস্থা থাকলে, নিজের নৈতিক অবস্থানে ভরসা থাকলে বিএনপি নেত্রী এবং তার পরিষদরা সমালোচনা এত ভয় পেত না। রাজপথে সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করতে পিছুটান দিত না। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতি দূষিত হয়ে গিয়েছে ক্ষমতায় থেকে মাতা-পুত্রের দুর্নীতির কারণে। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সংস্কৃতির চর্চা এমনভাবে করেছে যে, দলীয় নেতাকর্মীদের সর্বাঙ্গে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কড়া কোন প্রতিষেধক নিতে গেলে তাদেরই অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এই অবস্থাটা তারা নিজেরা বেশ ভাল বোঝেন বলে মাঝে মাঝে কিছু হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন। তার বেশি আর এগোবার নেই সক্ষমতা। জানে যে, বেশি এগোলে ঠগ বাজতে গাঁ উজার হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়ে যেতে পারে। বিপদে পড়তে পারেন নিজেরাও। বিএনপির শাসনামলে দুর্নীতির প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা পাহাড়সম। যে কারণে ‘উদ্দিন যুগের’ শাসকরা দুর্নীতির জন্য মাতা, পুত্র এবং বিএনপি দলের অনেক নেতার নামেই মামলা করেছে এবং অনেকে জেলে, কেউ জামিনে। খালেদা তনয়ের একটা মামলায় ইতোমধ্যে শাস্তির রায় হয়েছে। বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নাশকতার অভিযোগে ১৯টি মামলা রয়েছে। এর নয়টিতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে এবং দুটি দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে এখন রায় ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে। লন্ডনে রাজকীয়ভাবে বসবাসরত তারেকের একত্রিশটি মামলার এগারোটিতে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ছিয়াশি মামলার ২৪টিতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এভাবে অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এসব মামলার বিচারের গতি তত এগিয়ে যাবে। যে কোন একটি মামলায় সাজা হলেই নির্বাচনে অযোগ্য হবে। এসব মামলাগুলো বাতিলের দাবি জানাবে বিএনপি নির্বাচনের আগে। আর সে জন্যই তারা অনির্বাচিত সরকার চায় নির্বাচনের সময়। যাতে ‘লেভেল প্লেয়িং’ ফিল্ডের দাবি তুলে অপরাধীদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ খুঁজবে। বিএনপি-জামায়াত একটি মানসিকতা। যে মানসিকতা বাংলার মসনদে বসে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং উন্নয়নকে গলাটিপে হত্যা করতে ছিল সচেষ্ট। দুর্নীতির বিস্তার ও বিকাশ ঘটিয়েছে ব্যাপকভাবে। বিএনপি নেত্রীর কাছে ভিন্নমতের কোন মর্যাদা নেই। কেবলই আনুগত্য চান। ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য। ক্ষমতা তার নিজের মতামত শোনাবে এবং প্রশ্ন করবেÑ ঠিক কিনা! সবাই সমস্বরে বলবে ঠিক ঠিক! ক্ষমতা হবে আইনসিদ্ধ। প্রশ্নহীন আনুগত্যের এই দাবিদাররা গণতন্ত্রের সড়কে কথা বলতে, বাধ্য হলে, ‘ডাবলস্পিক’ ঠেকায় কার সাধ্য। যে কারণে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সুযোগ মতো বিএনপি আবার রাজপথে নামবে। রাজপথে যুদ্ধ করে সেই যুদ্ধে সফল হবে। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। সবই তাদের অক্ষমের আর্তনাদের মতো শোনায়। বিএনপির ‘গণতন্ত্র উদ্ধার’ নামক বচন শুনলে সেই ঢাকাইয়া গল্পের ‘ঘোড়া ভি হাসব’ মার্কা মন্তব্য উঠে আসে। এতকাল গণতন্ত্র সম্পর্কে বিএনপি নেতা-নেত্রীরা যা জেনেছেন, যা বুঝেছেন, তা সবই তাদের একচ্ছত্র দাপটের গল্প। মিল, রাসেল সবই তাদের সিলেবাস থেকে বাদ। ‘মার্শাল গণতন্ত্র’ যাদের রক্তমজ্জায়, সেই বিএনপি যখন জাতিকে গণতন্ত্রের পাঠ দেন, তখন বিস্ময় জাগে বাঙালীর অবয়বে। গণতন্ত্রের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এর নির্বাচন তবে গণতন্ত্র চর্চা ও বিকাশের জন্য শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানই যে যথেষ্ট নয় বিএনপি তা বিশ্বাস করে না। রাজনীতির যে একটা মানবিক মুখ রয়েছে, বিএনপি নেত্রী সেই মুখ দেখতে পান না। বরং মানবিক মুখ এর উল্টো মুখটাকেই আলিঙ্গন করতে চান। নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে বিএনপি। জামায়াতের রাজনীতি করতে গিয়ে এবং হেফাজতকে দিয়ে জ্বালাও পোড়াওসহ ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে উস্কে দিয়ে মানুষের মন থেকে সরে গেছেন। যে কারণে আর মাঠে নামতে পারছেন না। বিএনপি অন্তঃপ্রাণ ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরীও তাই বলতে পারেন ‘খালেদা জিয়াকে সাহস নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। আর কতদিন তিনি ঘোমটা দিয়ে বাড়িতে বসে থাকবেন!’ এছাড়া আর বিকল্প কি! স্ববিরোধিতায় আবৃত বেগম জিয়া নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার পর শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠিত হলে তারও বিরোধিতা করছেন। ‘মানি না, মানবো না’ নামক সেøাগানে বিশ্বাসী হয়ে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি শেষ পর্যন্ত আসবেন। কিন্তু এই আসার পথে পথে নানা প্রতিবন্ধকতা বা ব্যারিকেড তৈরি করবেনই। প্রয়োজনে গুপ্তহত্যা, অবরোধ, হরতাল, সন্ত্রাস এমনকি জঙ্গীবাদও বেছে নিতে পারেন। কিন্তু সবই ফুঁৎকারে উড়ে যাবে। কারণ জনগণ কোন অরাজকতা, নাশকতা চায় না। তারা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পাচ্ছে। আয় উন্নতি হচ্ছে। অভাব ক্রমশ দূর হচ্ছে। এই অগ্রগতির পথ ধরে আর কুড়ি মাস পর দেশে ভোটের উৎসবে নেমে জনগণ অতীতের ভোটের চেহারাটাই পাল্টে দেবে। যেমন পাল্টে ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে। সরকার যেহেতু বিএনপির হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়েছেন, সে জন্য যেনতেন প্রকারে তার বিরুদ্ধাচারণ করতেই হবেÑ এই নীতি থেকে বিএনপি সরবে না। যতই টালবাহানা করুক, জামায়াতকে রেখে বা ফেলে বিএনপি নির্বাচনে আসবেই। নতুবা রাজনীতির ডাস্টবিনে ঠাঁই নিতে হবে।
×