ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জেল-জরিমানার বিধান রেখে স্বাস্থ্যসেবা আইন করতে যাচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জেল-জরিমানার বিধান রেখে স্বাস্থ্যসেবা আইন করতে যাচ্ছে সরকার

আরাফাত মুন্না ॥ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করতে জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘স্বাস্থ্য সেবা আইন, ২০১৭’ করতে যাচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত আইনটিতে নাগরিক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অধিকার ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে সরকারের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকির জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এবং এ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘স্বাস্থ্যসেবা বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল’ গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে আইনের খসড়ায়। রবিবার এই আইনের খসড়া এবং সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে আইন কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এবং দুই সদস্য ড. এম. শাহ আলম ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর সুপারিশে স্বাক্ষর করেন। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় দেখা গেছে, সব মিলিয়ে ৬৫টি ধারা রয়েছে এই আইনটিতে। চৌদ্দ পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনটি। স্বাস্থ্যসেবা আইন, ২০১৭ এর খসড়ায় দেখা গেছে, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী অধিকার ও দায়-দায়িত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আইনের ৪ ধারায় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীর অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে কোন রোগে আক্রান্ত এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তি দেশের যে কোন চিকিৎসক বা সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালসহ সকল প্রকারের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হইতে স্বাস্থ্যসেবা পাইবার অধিকারী থাকিবে।’ প্রস্তাবিত আইনের ৫ ধারায় যে কোন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীকে সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র, মজুদ সাপেক্ষে বিনামূল্যে ঔষধ, নিবামূল্যে বা অনুমোদিত মূল্যে মানসম্মত খাবার ও পথ্য এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বা আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেবা পাওয়ার অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই ধারায় বেসরকারী হাসপাতালে রোগী ভর্তিসহ চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার বিধানাবলী, চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিতকরণ ও তথ্য সংরক্ষণের বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিধান সন্নিবেশিত রয়েছে। আইনের ৬ ধারায় যে কোন প্রকার বৈষম্য নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে, ‘কোন রোগীর চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, ভাষা, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, পেশা, পদবি, জাতীয়তা, জন্মস্থান কিংবা অন্য কোন কারণে কোনরূপ বৈষম্য করা যাইবে না।’ প্রস্তাবিত আইনের ৭ ধারায় প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে মর্টালিটি অডিট, ক্লিনিক্যাল অডিট ও মর্বিডিটি অডিট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন। আইনের ৮ ধারায় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীর ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, ‘চিকিৎসায় অসদাচরণ বা অবহেলার শিকার রোগী বা তাহার আইনানুগ প্রতিনিধি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হইতে যথাযথ ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকারী হইবে।’ আইনের তৃতীয় পরিচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি (চিকিৎসক), প্রতিষ্ঠানের (হাসপাতাল, ক্লিনিক ইত্যাদি) অধিকার ও দায় দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। আইনের ১২ ধারায় চিকিৎসকের দায়িত্ব ও ১৩ ধারায় নার্সদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং ১৩ ধারায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের চতুর্থ পরিচ্ছেদে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ যে কোন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে রোগীর অধিকার সংরক্ষণের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ ও তার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হয়েছে। আইনের পঞ্চম পরিচ্ছেদে চিকিৎসার রেকর্ড সংরক্ষণ এর বাধ্যবাধকতা, সেবা গ্রহণকারীর চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার অধিকার, রোগীর তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও তৃতীয় পক্ষের কাছে রোগীর তথ্য-উপাত্ত প্রকার করার বিধিবিধান তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের অষ্টম পরিচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনের ২৪ নম্বর ধারায় ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ফি নির্ধারণের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সরকার চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে রোগীপ্রতি ফি নির্ধারণ করিবে।’ ২৫ নম্বর ধারায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নির্ধারণের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সরকারী ও বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, ইটিটি, এমআরআই ইত্যাদি পরীক্ষার সর্বোচ্চ মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।’ প্রস্তাবিত আইনের নবম পরিচ্ছেদে চিকিৎসক, চিকিৎসা সহায়ক কর্মচারী ও চিকিৎসা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংঘটিথ বিভিন্ন প্রকারের অবহেলা ও এর ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ২৭ (১) ধারায় চিকিৎসকের অবহেলা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, ‘চিকিৎসক কর্তৃক যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অর্থাৎ- (ক) ভুল চিকিৎসা করা, (খ) রোগ নির্ণয়ে ভুল করা, (গ) ভুল ওষুধ প্রদান, (ঘ) ভুল অঙ্গ অপসারণ, (ঙ) ভুল বা অতিরঞ্জিত রিপোর্ট প্রদান, (চ) একাধিক রোগীকে একত্রে পরীক্ষা করা, (ছ) মাদকাসক্ত বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় চিকিৎসা দেয়া, (জ) জরুরী ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানে অহেতুক বিলম্ব করা, (ঝ) অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক টেস্ট দেয়া, (ঞ) ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন কোম্পানির একই ওষুধ বার বার প্রদান করা, (ট) প্রয়োজন ব্যতিরেকে নিজ ক্ষেত্রের বা এখতিয়ারের বাইরে চিকিৎসা দেয়া, (ঠ) কর্মস্থলে বিলম্বে আসা এবং কর্মঘণ্টা পূর্ণ হইবার পূর্বে কর্মস্থল ত্যাগ করা বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকা।
×