ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পর্ক ॥ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পর্ক ॥ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অন্যতম নিকটতম প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। যা বার্মা নামেও পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবিকার সন্ধানে বার্মায় যাতায়াত করতেন। তখন থেকেই বার্মার সঙ্গে এ দেশের মানুষের একটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভারত বাদে একমাত্র মায়ানমারের সঙ্গেই বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যোগাযোগের জন্য স্থলপথে মিয়ানমারকেই বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে। মায়ানমারের মধ্য দিয়েই সড়ক যোগাযোগ তৈরি করা সম্ভব। হতে পারে সম্পর্ক এবং সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত। মিয়ানমার প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ দেশ। টিন, জিঙ্ক, কপার, টাংস্টেন, কয়লা, মার্বেল, লাইমস্টোন, প্রাকৃতিক গ্যাস, জলবিদ্যুত ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে বিপুল পরিমাণ। এই দেশের বড় শক্তি খনিজ সম্পদ। বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার বাংলাদেশের জ্বালানির বড় উৎস হতে পারে। খাদ্যদ্রব্য, শস্যদ্রব্য বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় মায়ানমারে। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও মিয়ানমার বড় সহায়ক দেশ হতে পারে বাংলাদেশের। অথচ বাংলাদেশ কখনও এই সুযোগকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেনি। ১৩৫টি উপজাতি এবং ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর এই দেশটিতে সামরিক শাসন চলছে অনেক বছর ধরে। সম্পর্ক গভীরতর না হওয়ার হয়ত সেটাও একটা কারণ। মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক হলে ভারতের ওপর নির্ভরতা অনেক ক্ষেত্রে কমানো যেত। মায়ানমারের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনে যোগাযোগ তৈরি হলে, বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা তৈরি হতো। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুটোই স্বল্পোন্নত দেশ। চীন, ভারত, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া মায়ানমারের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও সামরিক বাজারসহ নানা বিষয়ে মিত্র হয়ে উঠছে এদেশের। আমেরিকার অবহেলাকে সুযোগ বানিয়ে মায়ানমারের সামরিক জান্তা চীনকে দুহাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বিনিয়োগে। তাই এ দেশের বড় বিনিয়োগকারী দেশ এখন চীন। আর্থ-রাইটস ইন্টারন্যাশনাল নামের এক বেসরকারী গ্রুপের তথ্যমতে, ২৬টিরও বেশি চাইনিজ কোম্পানি মায়ানমারের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ এবং তৎসংলগ্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করছে। ইতোমধ্যে মায়ানমারের অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও অস্ত্র সরবরাহে চীন তার বড় বন্ধুপ্রতিম দেশে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার শুধু চীনের সঙ্গেই নয়, সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে ভারতের সঙ্গেও। ভারত ও চীন পাল্লা দিয়ে মায়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। মিয়ানমার প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে আমেরিকাও। তাই সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ আমেরিকা। সম্প্রতি বাংলাদেশ-মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নিয়ে ৪১ বছরের বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ফলে ১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মায়ানমারের জলসীমাও চিহ্নিত হয়েছে। ফলে এই সমস্যাটি কেটে গেছে। বঙ্গোপসাগরে উত্তেজনা সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়েছে। খনিজ, আকরিক, তেল, গ্যাস, মূল্যবান পাথর ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মিয়ানমার। দেশটি বিশ্বের প্রাকৃতিক কাঠের প্রধান সরবরাহকারী। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ তেল ও গ্যাস খাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও দেশটি সম্প্রতি উৎপাদনভিত্তিক বিনিয়োগ আকর্ষণে মনোযোগী হয়েছে। জলবিদ্যুত উৎপাদনে ভাল বিনিয়োগ হওয়ায় দেশটি বিদ্যুত উৎপাদনে বেশ এগিয়ে আছে। পর্যটন শিল্পও দেশটির একটি সম্ভাবনাময় খাত। মায়ানমারের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ বিধায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর জোসেফ স্টিগলিস দেশটিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে ‘সম্পদের অভিশাপ’-এ ভুগতে হবে দেশটিকে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান ও বেনিনসহ কিছু সম্পদনির্ভর দেশ দুর্নীতি, অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে। সম্পদই ছিল দেশগুলোর কাল। মায়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসলে এবং দুর্নীতি কমাতে পারলে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ দেশগুলোর পর্যায়ে যেতে হবে না বলেই অর্থনীতিবিদরা ধারণা করেছেন। তাই ধরে নেয়া যায়, মিয়ানমার কয়েক বছরের মধ্যেই দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশে পরিণত হবে। দেশটির বড় অর্থনৈতিক সুবিধা হচ্ছে, এরা দশ-জাতির আশিয়ানের সদস্য। বিশ্বের সফল তিনটি বাণিজ্য ব্লকের মধ্যে আশিয়ান একটি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাউস ও মিয়ানমারকে নিয়ে গঠিত এ বাণিজ্য। মোট বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ২৪ শতাংশ এ জোটের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং প্রতিবছরই বিশ্ব বাণিজ্যে তাদের শেয়ার বাড়ছে। বাণিজ্য বৃদ্ধির কারণে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে। আশিয়ান দেশগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে ও এ তিনটি দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের ৫০ শতাংশেরও বেশি করছে। ফলে এ বাণিজ্য জোট তথা মায়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বহুখাতভিত্তিক কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগ বা বিমসটেকের সাত সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আছে। তাই বিমসটেকের মাধ্যমেও দুই দেশের বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মায়ামারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধির অনেক সুযোগ আছে। গ্যাস ও বিদ্যুত আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যত জ্বালানি নিশ্চয়তা লাভ করতে পারে। দুই দেশ যৌথ উদ্যোগে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে পারে। বাংলাদেশ মায়ানমারের অবকাঠামো উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে নির্মাণের মাধ্যমেও দুই দেশের মধ্যে স্থল যোগাযোগ বাড়তে পারে। এবং নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধিরও যথেষ্ট সুযোগ আছে। এছাড়া সার, প্লাস্টিক, সিমেন্ট, ফার্নিচার প্রভৃতি খাতে যৌথ বিনিয়োগ করা যেতে পারে। মায়ানমারের কাঁচামাল এবং বাংলাদেশের দক্ষতা, কারিগরি জ্ঞান ও শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন করলে উভয় দেশই লাভবান হবে। কারণ, মিয়ানমার এ প্রতিটি পণ্যই আমদানি করে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকও রফতানি করতে পারে। কৃষিখাতেও উভয় দেশ যৌথ উদ্যোগে উৎপাদন বাড়াতে পারে। যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণ ছাড়াও বাংলাদেশ ডাল, মসলা, মাছ, চালসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়াতে পারে। এভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়াতে পারলে তা আশিয়ান ও বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারবে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বাংলাদেশের।
×