ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন আশায় জেগে উঠছে চা শিল্প

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নতুন আশায় জেগে  উঠছে চা শিল্প

বাংলাদেশের চা শিল্প প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী। আমরা সবাই জানি- পানির পর চা হলো বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। প্রতিদিন সারা বিশ্বে গড়ে দুই বিলিয়ন কাপ চা পান করা হয়। বাংলাদেশে চা উৎপাদনের বিপরীতে ভোগ বৃদ্ধির হার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি। ফলে উৎপাদন বাড়লেও চা আমদানি কমছে না। দেশীয় চাহিদার শতভাগ মিটিয়ে রফতানি বাড়াতে হলে ভাল চা উৎপাদনেও এগিয়ে আসতে হবে। চা বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে ১৬২টি চা বাগানে মোট ৬৪ হাজার ৮৮৬ হেক্টর চাষযোগ্য ভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ হাজার ১৮ হেক্টর জমিতে চা চাষ হলেও বাকি ৫ হাজার ৮৬৮ হেক্টর অনাবাদি রয়েছে। গত এক দশকে চা বোর্ডের নেয়া সম্প্রসারণ কার্যক্রমের আওতায় পঞ্চগড় ও বান্দরবান জেলাকে চা চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির পথে চা উৎপাদন ও রফতানিতে একসময় সারা বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম ছিল বাংলাদেশ। দেশে চা পান করার ব্যাপকতা দ্রুত বাড়লেও উৎপাদনের গতি বাড়েনি। আশার কথা হলো- গত দুই বছরে চা উৎপাদনে বড় অগ্রগতি দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এক বছরের ব্যবধানে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি। জানা গেছে, ভারত ও চীনে হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদন দুই হাজার কেজির বেশি। শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। দেশীয় বাগানগুলোয় হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদন দীর্ঘদিন ১ হাজার ২০০ কেজির ঘরে থাকলেও গত বছর তা দেড় হাজার কেজি ছাড়ায়। ২০১৫ সালেও চায়ের হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ১ হাজার ২৭০ কেজি। ২০১৬ সালে এ পরিমাণ বেড়ে রেকর্ড ১ হাজার ৫৮৭ কেজিতে দাঁড়ায়। চা বোর্ডের বার্ষিক উৎপাদন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জুন-অক্টোবর সময়ে দেশের ১৬২টি বাগান থেকে গড়ে ১০ মিলিয়ন কেজিরও বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে চা উৎপাদন অচিরেই ১০০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন চা বোর্ডের কর্মকর্তারা। জাতীয় অর্থনীতিতে বাংলাদেশের চা চা চাষের জন্য প্রয়োজন অধিক বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ ঢালু অঞ্চল, অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয় বলে বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলই চা চাষের জন্য অধিক উপযুক্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৭,৭৮১ হেক্টর জমিতে ১৬৩টি চা বাগান রয়েছে। জেলাভিত্তিক চা বাগানের মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রামে ২২টি, সিলেটে ২০টি, রাঙ্গামাটিতে ১টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি এবং পঞ্চগড়ে ৫টি। চা শিল্পের বিকাশে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একটি চা জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে প্রতি বছর বাংলাদেশে চা উৎপাদন এক দশমিক ৩৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন ও মানুষের চা পানের প্রবণতা বৃদ্ধি ও অভ্যাস পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ তিন দশমিক ৮৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে চা উৎপাদনে ১১তম। চা শিল্পে বাংলাদেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্র্যান্ডকে পরিচিত করে তুলেছে দেশে বিদেশে। যেমনÑ ইস্পাহানি মির্জাপুর চা, ইউনিলিভারের তাজা ব্র্যান্ডের চা, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের চা, দ্য কনসোলিডেটেড টি এ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেডের ফিনলে চা, আবুল খায়ের গ্রুপের সিলন গোল্ড চা, এইচআরসি গ্রুপের এইচআরসি চা, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের প্রাণ চা, কাজী এ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের অর্গানিক মিনা চা। দেশে প্রায় শূন্য দশমিক ৮১ ভাগ জিডিপি অর্জিত হয় চা শিল্প থেকে। বর্তমানে চায়ের বার্ষিক উৎপাদন ছয় কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজার কেজি। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ লোক চা শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। যার মধ্যে প্রায় ১,৫০,০০০ শ্রমিকই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত চা দু’দশক আগেও বিশ্বের ২০-২২টি দেশে রফতানি করা হতো। অন্যতম প্রধান ক্রেতাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সিআইএসভুক্ত দেশগুলো, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, মিসর, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস। এখন তারা বিকল্প চা উৎপাদক দেশগুলোর দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭টি চা রফতানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫। উন্নয়নে পথ নক্সা : বাংলাদেশ চা শিল্প চা উৎপাদন এবং রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের রূপকল্প-২০২১ বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ চা বোর্ড ৯৬ হাজার ৭৩৫ দশমিক ৭০ লাখ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ১২ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সরকারের নীতি এবং ভিশন-২০২১-কে সামনে রেখে পরিকল্পনাটি তিন পর্যায়ে ১০টি প্রকল্প প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেশের চা শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে ‘উন্নয়নের পথ নক্সা বাংলাদেশ চা শিল্প’ নামে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চা বোর্ড। ২০২৫ সালে দেশে চা উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ১৪০ মিলিয়ন কেজি। চা বোর্ডের তথ্যে জানা যায়, প্রকল্পটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করেছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, বাগান সম্প্রসারণ, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, গভীর ও হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন, বাগান এলাকায় কূপ খনন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ ও সড়ক উন্নয়ন ইত্যাদি। প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের চা চারা রোপণ করা হবে। ১০ হাজার হেক্টরে চা বাগান সম্প্রসারণ করা হবে। ১৫ হাজার চা শ্রমিকের গৃহনির্মাণ ও ১৫ হাজার টয়লেট নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প এলাকায় ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন, ৫০টি কালভার্ট ও ৪টি সেতু নির্মাণ করা হবে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘মাদার ক্লাব’ করা হবে। চায়ের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১১৫৬২৯.৭৬ হেক্টর থেকে বর্ধিত করারও প্রচেষ্টা চলছে। আশা করা হচ্ছে চা শিল্প উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চা শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর চা রফতানি করা সম্ভব হবে।
×