ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অসহায় চালকরা ॥ মন্ত্রীর নির্দেশেও বন্ধ হয়নি

বগুড়ায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বগুড়ায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ দরিদ্র ভ্যানচালক ডালিম শনিবার সকালে পরিবারের একমাত্র উপার্জন মাধ্যম ব্যাটারিচালিত রিক্সাভ্যান নিয়ে বাড়ি থেকে শহরে এসেছিলেন। শহরের সড়কে এসেই পড়লেন নিষ্ঠুর সড়ক চাঁদাবাজদের মুখে। প্রতিদিনের চাঁদা ও সমিতির ভর্তির নামে চাঁদা আদায়কারীদের নির্ধারিত আড়াই হাজার টাকা না দেয়ায় চকযাদু সড়ক থেকে কেড়ে নেয়া হলো তার বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকার সঙ্গী রিক্সাভ্যানটি। এরপর অসহায়ত্ব ও ভীতি নিয়ে ডালিম দুপুর পর্যন্ত একটানা ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে। ছোট্ট এরকম চিত্র বগুড়ায় শহরের সব সড়কে। চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। যার শিকার দরিদ্র রিক্সা ভ্যান, ইজিবাইক ও অটোরিক্সা চালক। শুধু ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও রিক্সাভ্যান এবং ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হচ্ছে তিন লক্ষাধিক টাকা। শহর থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এই চাঁদা আদায় চলছে। এমনকি সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী সম্প্রতি বগুড়া সফরকালে প্রশাসনকে সড়ক চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বললেই তা বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন যার মাসুল গুনতে হচ্ছে ভ্যান চালক ডালিমের মতো অসাহায় গরিব মানুষদের। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান ডালিম চলতি মাসেই একটি এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা কিস্তিতে ঋণ নিয়ে পুরানো রিক্সাভ্যানে ব্যাটারি সংযোজন করে সংসারের অনটন ঘুটানোর জন্য। এখন সেটাই তার দুশ্চিন্তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহাসড়কে চাঁদাবাজির সঙ্গে বগুড়ায় যোগ হয়েছে জেলা চার্জার রিক্সা ও রিক্সা ভ্যান মালিক সমিতি ও ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা (ইজিবাইক) মালিক সমিতির নামে চাঁদাবাজি। এসব সমিতির শাখা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে উপজেলা পর্যন্ত। ব্যাটারিচালিত চার্জার রিক্সা ও ভ্যান থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা ও সমিতি ভুক্তি বা চাঁদাবাজদের লাইসেন্স ফি বাবদ এককালীন ১৮শ’ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা নির্ধারিত। আর প্রতি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ৬০ টাকা ছাড়াও সমিতিভুক্তির এককালীন টাকা রয়েছে। এসব টাকা প্রশাসনের সামনেই প্রকাশ্যে আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা। সূত্র জানায়, বগুড়ায় ১০/১২ হাজারেরও বেশি চার্জার রিক্সা ও ভ্যান থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।ভর্তি ফি বাবদ নির্ধারিত টাকা নেয়ার পর প্রতিটি রিক্সা ও রিক্সাভ্যানে সমিতির সদস্য স্টিকার সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে। এই স্টিকার সড়কে রিক্সা ও রিক্সাভ্যান চালানোর লাইসেন্স (!) হিসাবে গন্য করা হচ্ছে। ১৮শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা দিয়ে সমিতির সদস্য পদ নিয়ে বৈধ! ভাবে শহরের ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও রিক্সাভ্যান চালান যায়। অন্যথায় নেমে আসে চাঁদাবাজদের নিষ্ঠুর নির্যাতন। শহরের নামাজগড়, কামারগাড়ি, নারুলি, ইয়াকুবিয়ার মোড়, গোহাইল রোড, বড়গোলা, মাটিডালি, পিটিআই মোড়, রহমাননগর, সাতমাথা, চারমাথা, তিনমাথা, নিশিন্দারা, উপশহর, কালিতলাসহ শহরের মোড়ে মোড়ে রিক্সা ও রিক্সাভ্যান ও ইজিবাইক থেকে চাঁদা আদায় হচ্ছে জোরপূর্বক। রিক্সা চালক সাবু, শফিকুল, জহুরুল, রবিন, আলম ও শাহীনের বাড়ি শহরতলীসহ গ্রাম এলাকায়, প্রতিদিন তারা শহরের আসেন ভ্যান ও রিক্সা নিয়ে। তারা জানালেন, মোড়ে মোড়ে থামিয়ে তাদের নিকট থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। প্রতি পয়েন্টে থাকে ৩/৫ জনের যুবক। কেউ চাঁদা না দিলেই মোবাইল ফোনে ‘বাহিনী’ ডাকা হয়। এরপর প্রকাশ্যে অমানুষিক মারপিটসহ রিক্সা ভ্যান কেড়ে নেয়া হয়। যাদের সমিতির সদস্য হননি, তাদের নিকট থেকেই রিক্সা ও রিক্সা ভ্যান কেড়ে নিয়ে সমিতি ভুক্তির টাকা না দেয়া পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। ২ কপি ছবি, ভোটার আইডি কার্ড ও আড়াই হাজার টাকা।এই ৩ শর্ত মানার পরেই মুক্তি মিলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদায়কারীরা সমিতি থেকে ১শ’ পাতার রশিদ নিয়ে আসে ১৫শ’ টাকা দিয়ে। এরপর সকাল থেকে আদায় করা হয় ২০ টাকা হারে চাঁদা। আদায়কারীরা প্রতি রশিদে পায় ৫ টাকা আর সমিতিতে যায় বাকি ১৫ টাকা। আর উপজেলা পর্যায়ে একই কায়দায় রিক্সা ও রিক্সা ভ্যান থেকে চাঁদা আদায় হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকা ভাগ হয়ে যায় বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন মহলে। ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক থেকে ৬০ টাকা আর একই ভাবে সিএনজি অটোরিক্সা থেকেই রুট ভেদে বিভিন্ন ৪০ থেকে ৬০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। আর মহাসড়কে তো চলছে আগের মতোই রকমারি চাঁদা। ২৭ জানুয়ারি বগুড়া সফরে এসেছিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বগুড়া অবস্থান কালে তিনি রিক্সা ও রিক্সা ভ্যানসহ সড়ক চাঁদবাজির বিষয়টি জানতে পেরে প্রশাসনকে চাঁদা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। তবে শনিবার বগুড়ার বিভিন্ন পয়েন্টে গিযে চাঁদা আদায়ের তৎপরতা দেখা গেছে। এ ব্যাপারে বগুড়ার জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন জানিয়েছেন, সেতুমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়া পর পুলিশ প্রশাসনকে জানান হয়েছে। এ ব্যাপারে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল জানিয়েছেন, চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, দু-একটি জায়গায় চাঁদা আদায় হয়ে থাকলে সে ব্যাপারে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে। বগুড়ার টাফ্রিক পুলিশ জানিয়েছে, চাঁদা আদায়ের বিষয়ে তাদের নিকট কেউ অভিযোগ করেনি।
×