ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মান্ধদের উন্মাদনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ধর্মান্ধদের উন্মাদনা

দেশকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সামনে দাঁড় করিয়ে যারা ফায়দা লোটে, তাদের কণ্ঠনালী থেকে মানবতা, শান্তি, সৌহার্দ্য, এমনকি অসাম্প্রদায়িকতার বাণী নিঃসৃত হতে পারে না। অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, হীনম্মন্যতা তাদের এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে যে, স্বাভাবিকতার মধ্যে তারা প্রাণ পায় না। মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা, কূপম-ূকতা আর অর্বাচীনতায় এমনভাবেই আচ্ছন্ন যে, তাদের বদ্ধমূল ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার বাইরেও যে বিশাল জগত রয়েছে, তা তাদের বিশ্বাসবোধ ধারণ করে না। বাংলাদেশের জীবন দর্শনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা এবং সভ্যতা সংস্কৃতির মূলে আঘাত করার লক্ষ্য নিয়ে যারা উচ্চকণ্ঠ, তারা সমাজকে বিভাজনের, অস্থিতিশীলতার, অরাজকতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিতে চায়। সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, সহনশীলতা, যুক্তিবোধকে অস্বীকার করে ধর্মাশ্রয়ী কথিত রাজনীতিকে বৈধরূপ দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কোনরকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই প্রাচীন সংস্কার ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরার লোকও এ জগতে কম নয়। তারা বর্তমান ও ভবিষ্যতকে অস্বীকার করে ক্লিশে হয়ে যাওয়া অতীতকে আঁকড়ে ধরে মানবজীবনের ক্রম বিকাশকে ব্যাহত করতে চায়। আমরা জানি প্রকৃত ধর্ম মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা শেখায়। পারস্পরিক হানাহানির কথা শেখায় না। এদেশে যারা ধর্ম প্রচার করেছেন, তারা অপর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়, সহমর্মিতার কথা বলেছেন, তা একালের ধর্ম ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোড়ন তোলে না। কারণ, ধর্মকে তারা বর্ম বানিয়ে বৈষয়িক ফায়দা তোলার জন্য এক ধরনের ব্যবসা করেন। কুসংস্কারকে এরা জীবনদর্শন হিসেবে প্রচার করে। সুতরাং এরা সভ্যতা সংস্কৃতি ইমান আকিদার কথা শেখাতে পারে না। এরা নিজেরাই নিজেদের ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে আছে। তাই সবকিছুই হয়ে ওঠে নেতিবাচক। একাত্তরে ধর্ম ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান হানাদারের সহযোগী হয়ে বাঙালী নিধন শুধু নয়, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সবই চালিয়েছে ধর্মের নামে। এদের উত্তরসূরিরা স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার শুধু নয়, সশস্ত্র যুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার সব মূলমন্ত্র উপড়ে ফেলে পাকিস্তানী ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় হেন কাজ নেই করছে না। ২০১৩ সালের মে মাসে ধর্ম ব্যবসায়ীরা খোদ রাজধানীতে যে তা-ব চালিয়েছে, তা ধর্ম এবং মানবতাবিরোধী। তারা ধর্ম গ্রন্থও পুড়িয়েছে। দোকানপাট, অফিস আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শুধু নয়, নারী সাংবাদিককে ধাওয়া করে লাঞ্ছিতও করেছিল। কোমলমতি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তির আড়ালে রেখে এসব অধর্মজাত নাশকতায় লিপ্ত হয়েছিল। এরা শান্তির ধর্মে আস্থাশীল হলে এমন কাজ করতে পারত না। পাঠ্যপুস্তকে কি পড়ানো হবে, সেটাও তারা নির্ধারণ করে দিতে চায়। সর্বশেষ সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য অপসারণে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এদের স্পর্ধা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এদের সব তৎপরতাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। ন্যায় বিচারের সূচক দাঁড়িপাল্লা, দ- বা শাস্তির সূচক তলোয়ার এবং নিরপেক্ষভাবে বিচারের প্রতীক হিসেবে চোখ বাঁধা ভাস্কর্যটি তাদের পিত্তিতে কেন জ্বলুনি বাড়ায়, তা বোধগম্য নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বিচারের নিরপেক্ষতা তুলে ধরা হয় এই রোমান ভাস্কর্যের মাধ্যমে। রোমান আইনই পৃথিবীতে আইন প্রণয়নের মূল। ন্যায় বিচারে যারা বিশ্বাসী নয়, মানুষ কতল করার মধ্যে যারা জীবনের স্পন্দন পেতে চায়, তাদের ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান রাজনৈতিকহীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এরা বিচারালয়কেও বিতর্কিত করে দেশকে মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায়। এদের মোকাবেলা করার দায়িত্ব সরকারের যেমন, তেমনি জনগণেরও। এসব স্বদেশ ও মানবতাবিরোধীদের নির্মূল এবং উৎপাটনেই সাম্য, মৈত্রী ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যা প্রায় সব ধর্মেরই মূলমন্ত্র।
×