ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহাম্মদ সামাদ

কবিতা মানে না বর্বরতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কবিতা মানে না বর্বরতা

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের পূর্বসূরিদের নিরন্তর সংগ্রাম, ত্যাগ আর আত্মদানের পরম্পরায় স্বজনের রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ। আজ থেকে তিন দশক পূর্বে সামরিক স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর দেশে দেশে সংঘটিত সকল অশুভ, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তার অবসানের আকাক্সক্ষা আর অঙ্গীকার নিয়ে তিরিশটি জাতীয় কবিতা উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। এই তিরিশটি উৎসবের সেøাগান বা মর্মবাণী এবং আমাদের প্রধান কবিদের ভাষণ ও বক্তব্যে তার প্রমাণ উৎকীর্ণ রয়েছে। সাহিত্যে ও সমাজে আদিমতা, বন্যতা, অসভ্যতা, নীচতা ও ক্ষুদ্রতার নির্দেশক হলো বর্বরতা। এ মুহূর্তে পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে হাজারটা প্রশ্ন এসে মাথায় ভিড় করে: কালো মুখোশে ঢাকা ধর্মের নামে মানবসন্তানের শিরñেদ কি মানুষের কাজ? কেন এখনও এত যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি? ভূমধ্যসাগরের তীরে, ইরাবতী ও নাফ নদের পূত জলরাশিতে অসহায় নারী-শিশুর এত আর্তনাদ কেন? যশোরের ভৈরব নদের তীরের এবং নাসিরনগরের আগুনের লেলিহান শিখায় কি আমাদের গা পুড়ে না? সবুজ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ক্ষুধায় জনবসতির উচ্ছেদ কি আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেব? নানা ছল-ছুতায় প্রতিদিন নিষ্পাপ শিশুর ওপর বীভৎস নির্যাতন বা অকাল সংহার কি কখনও কাম্য হতে পারে? অথবা, একজন একগুঁয়ে ও অনুদার ব্যক্তিকে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করে সভ্যতার মুখে কালিমালেপন করেছে কারা? আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার শান্ত, নিস্তরঙ্গ জনপদে; লাতিন আমেরিকার ঘন জঙ্গলে মারণাস্ত্র পাঠিয়ে মানবতাকে বিপন্ন করে তুলেছে কারা? তথ্য-প্রযুক্তি প্রসারের সুযোগে অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়ে জীবনের সৌন্দর্যকে কলুষিত করে চলেছে কারা? বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যসূচিতে উগ্র মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বুনে দিয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সঙ্কুচিত করে চলেছে কারা? আমরা সকলেই জানি এরা কারা। এভাবে, জেনেশুনে ক্ষমতার দর্প, চোখ ধাঁধানো কিছু অট্টালিকা, আতশবাজি এবং ফানুস সদৃশ মুষ্টিমেয় তথাকথিত কেতাদুরস্তদের হাতে একটি সুন্দর পৃথিবীর সম্ভাবনাকে অর্পণ করা কি অন্যায় ও গর্হিত হবে না? বলা বাহুল্য, সকল শিল্পের দাবি তো একটাইÑ অসত্য, অন্যায়, কূপম-ূকতা, কলুষ ও অমঙ্গলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর সুন্দরের আবাহন। সুন্দরকে পেতে হলে কৃষি খামার, কল-কারখানা, অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক উন্নয়নের পাশাপাশি কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, সঙ্গীত, নাটক, চিত্রকলাসহ অন্যান্য শিল্প-মাধ্যমের চর্চাক্ষেত্র প্রসারিত করা অপরিহার্য। সেই পথে মানব উন্নয়নের ধারাকে বেগবান করতে না পারলে সমাজে যে অস্থিরতা ও অস্বস্তি সৃষ্টি হবে, তা পরিণতি পাবে বর্বরতায়। কবিতা ও শিল্পমাধ্যমের সকল ধারার সঙ্গে শিক্ষার যোগ নিবিড়। আজকের বাংলাদেশে শিক্ষার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিস্তৃতি ঘটলেও, মান খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার প্রধান পাদপীঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈষয়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়ায় বিকশিত হচ্ছে না জ্ঞানের সাধনা ও গবেষণার ক্ষেত্রসমূহ। ন্যূনতম প্রস্তুতি ছাড়াই উচ্চশিক্ষার দ্বার অবারিতকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, উৎকট প্রচারণা ও নিছক আনুষ্ঠানিকতায় মত্ত থাকার কারণে আগামী দিনে দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এভাবে চলতে থাকলে, অচিরেই জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে বিদ্যাধর, সংস্কৃতিমনস্ক ও হৃদয়বান মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার হবে। সমাজ প্রগতির আন্দোলনে, স্বাধীনতা, সাম্য ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামে কবিতার উজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে অমলিন। এই মাটিতেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন; বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কবিতার সঞ্জীবনী শক্তি জনমানুষের চেতনাকে শাণিত করেছে; আমাদের পৌঁছে দিয়েছে মুক্তির মন্দিরে, সাফল্যের দুয়ারে। প্রকৃতি, নারী ও মানবের বেদনা, বিদ্রোহ ও আনন্দের শিল্পীত প্রকাশ কবিতা। কবিতার সৌন্দর্য অপার। যেমন, কোনো রূপবতী নারী ও ধ্রুপদী চিত্রকর্মকে আমরা বলিÑ দেখতে ঠিক নিটোল কবিতার মতো, কালোত্তীর্ণ কাহিনীকে বলি মহাকাব্যিক, তেমনি সুন্দরের আরাধনায় কবিতা ক্লান্তিহীন। পৃথিবীতে সুন্দরের সমূহ সর্বনাশ থামিয়ে দেয়ার মানসে এই একত্রিশতম জাতীয় কবিতা উৎসবের সেøাগানে ও গানে আমরা ধ্বনিত করেছি আরও একটি নতুন বারতাÑ ‘কবিতা মানে না বর্বরতা বা বর্বরতা মানে না কবিতা’। কবিতার সদাবহমান অমৃতধারায় হৃদয় পবিত্র হোক; মরুভূমি উর্বর হোক; ফুলে-ফলে ধন-ধান্যে সতেজ সবুজে ভরে উঠুক বসুন্ধরা। সকল প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য হয়ে উঠুক পৃথিবী। আজকের দিনে এই আমাদের প্রার্থনা। জয় বাংলার। জয় কবিতার। [একত্রিশতম জাতীয় কবিতা উৎসবে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদের সভাপতির ভাষণ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত]
×