ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সাইলেন্ট মেজরিটিকে ভাইরেন্ট করলেই জয়ী হতে পারব আমরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সাইলেন্ট মেজরিটিকে ভাইরেন্ট করলেই জয়ী হতে পারব আমরা

কোন দেশের মধ্যবিত্ত না জাগলে সেদেশের মানুষ জাগে না। এটা ঐতিহাসিক সত্য। আমাদের দেশে যতগুলো বড় ঘটনা ঘটেছে সবগুলোর পেছনে আছে মধ্যবিত্ত জাগরণ। এরশাদ পতনে তাদের সায় না থাকলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফলতার মুখ দেখত না। সর্বশেষ যে শাহবাগ তাও কিন্তু মধ্যবিত্তের জাগরণ। অন্যদিকে শাপলার সমাবেশ ব্যর্থ হবার কারণ ছিল মধ্যবিত্তের ভয় ও নিস্পৃহ মনোভাব। এই মধ্যবিত্ত এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের ব্যাপারে কোন সাবধান বাণী বা ভবিষ্যদ্বাণীও টেকে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশের বাঙালীর এমন দ্বৈত চেহারাও বহুমুখী আচরণ মানা যায় না। বিদেশে বাঙালীর জীবনে রাজনীতি এক বিশাল বিষয়। নিরাপদ দেশ ও সমাজে থাকার পরও তাকে নিশিদিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াত নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখি। অন্যদিকে দেশের মানুষের মনে রাজনীতি এখন ভয়ের বিষয়। এই ভয়টা এমন সংক্রামক একদল যদি দেশকে উন্নয়নের শীর্ষেও পৌঁছে দেয় তার প্রতি ভীতি আর বিদ্বেষ যায় না। কিছু মানুষ দেশে-বিদেশে নিশিদিন বলে বেড়ায় বাংলাদেশের এগোবার কথা ছিল তাই এগোচ্ছে। ফলে এখানে সরকার শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কিছু করার নেই। ভাবখানা এই গাড়ি চালক ছাড়াই চলে বা কোন জাহাজ গন্তব্যের দিকে এগোতে পারে নাবিক ছাড়াই। এই যে ভয়াবহ বোধ এর পেছনে কাজ করছে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদ। তারা গাছের খাবে তলারও কুড়াবে। দেশে রাজনীতি নেই, গণতন্ত্র নেই বলে যারা ফাল পাড়েন তারা বিএনপির কোন দোষ বা জামায়াতের কোন খুঁত দেখেন না। এই যে সিইসি নিয়ে বিএনপির মতভেদ বা না মানার প্রবণতা এটার আসল মানে সবাই জানেন। কোন হুদাই তাদের মনপছন্দ হওয়ার কথা না। সেটা নূরুল হুদা হোক আর ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাই হোক। বেহুদা প্যাচাল পাড়া ছাড়া কি কাজ তাদের? কিন্তু তারা খুব ভাল জানে ইলেকশন ঠিকমতো হলে এই মধ্যবিত্ত তাদের দিকে হেলে পড়তে পারে। এরশাদ পতনের পর দেশের সবাই ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগই আসছে দেশ শাসনে। আমি তখন চট্টগ্রামে। এরশাদ পতনের পরপর নিউমার্কেটের মোড়ে সমবেত লাখো জনতার সামনে প্রাক্তন মেয়র আওয়ামী নেতা এবিএম মহীউদ্দীন চৌধুরী প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের হাত উঁচিয়ে ধরে অভিভাবকের সুরে বলেছিলেন, এই নোমান আমার ভাই। আমরা আন্দোলন করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। বেচারী নোমান সে সভায় কথা বলারও সুযোগ পাননি তেমন। অতঃপর ভোটের দিন দুপুর বেলায় মহীউদ্দীনকে মালা পরিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে আগাম জয়ীর খেতাব দিয়ে বাড়ি ফেরা স্তাবকেরা সন্ধ্যার পর আর বেরুতে পারেননি। তখন পরিবেশ গেছে পাল্টে। চারদিকে নৌকার অফিস ঘর ভাংচুর আর ধানের শীষের বিজয় মিছিলে সয়লাব। সেই নির্বাচনের পর নেত্রীর কারচুপির অভিযোগ নিয়ে মন কষাকষিতে ড. কামাল হোসেনের মতো নেতাও ছিটকে পড়লেন চিরতরে। নৌকার পালে বাতাস লাগাতে পাঁচ বছর একটানা পরিশ্রম ও সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তারপরও মূলত বিএনপির খাই খাই মনোভাব আর হামবড়া ভাবের জন্য কানের কাছে গুলি যাবার মতো কোনক্রমে বেঁচে গিয়ে কোনভাবে ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নেত্রী শেখ হাসিনা। আমরা ভুলে যাইনি সে সময়ের সব ভাল কাজ বা আওয়ামী লীগের হাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনর্বার জাগরিত হলেও তার মূল্য পাওয়া যায়নি পরের ইলেকশনে। সেই সরকারের এক মন্ত্রী আসম রবের আজকের চেহারা দেখুন। বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে থাকার জন্য বলেননি হেন কোন কথা নেই। মন্ত্রিত্ব যাবার পর তিনি এখন আওয়ামী লীগের নাম দিয়েছেন আপদ। জাসদের এই চরিত্র তার প্রায় প্রত্যেকটি নেতার ভেতর কোন না কোন ভাবে লুকিয়ে আছে। আজকে যারা শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নিন্দায় পঞ্চমুখ তাদের বিশ্বাস করা কঠিন বটে। বিএনপি খুব ভালো করেই জানে এদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ এক অস্ত্রের নাম সাম্প্রদায়িকতা। যতদিন আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে তার ভূমিকা স্পষ্ট রেখেছিল তাকে কাবু করতে পারেনি তারা। কিন্তু এখন তাদের নেতারা দোটানায়। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া বাকিরা সব বিষয়ে আপোসের বৃত্তে। এই আপোসের কারণে লেজে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছে শাহবাগ। মরতে মরতে জান নিয়ে ধুকধুক করছে জামায়াত। এই খেলায় সময় যায় বটে, ফল মিলবে না। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মাঠে থাকা আর ঘর গোছানোর কাজ আসলে কে করবে? এখন রাজনীতি ময়দানে হয় না। তার একদিকে লবিং, আরেকদিকে জনগণ। বাংলাদেশের জনগণের যে অংশটি মধ্যবিত্ত তার গায়ে এখন মরুর হাওয়া। তাকে তার নবজাতক শিশু এবং পাঠ শিখতে শুরু করা বাচ্চাকে দেয়া হচ্ছে ভয়ানক সব দাওয়াই। এদেশে কোনদিন যা হয়নি তাই হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাদ পড়ছে। নজরুল সম্পাদিত হচ্ছেন। ইচ্ছেমতো কাটা-ছেঁড়ার শিকার হচ্ছেন লেখকরা। এটাই কি মধ্যবিত্তের মন যোগানোর নতুন কায়দা? যে বিষয়টা ভাবার এভাবে আপনারা কার ইচ্ছে কাদের পারপাস সার্ভ করছেন? যাদের ভোটব্যাংকে আপনাদের অধিকার তাদের মূর্তি ভেঙ্গে দেশছাড়া করলে কি আপনারা আমজনতার কাছে প্রিয় হয়ে যাবেন? দেশে-বিদেশে কোন লবিং-এ আওয়ামী লীগের যতটা সার্থকতা শাসনভারে না থেকেও বিএনপি ততটাই সফল। তাদের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিও কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায়নি। খালেদা জিয়ার বয়স ও শারীরিক অযোগ্যতা বাদ দিলে তাদের মাইনাস পয়েন্ট অনেক কম। তারা খুব ভাল করে জানে এদেশের নীরব জনগণ ভারতের নামে আতঙ্কিত। সে আতঙ্ক আওয়ামী লীগ কি তাড়াতে চেয়েছে? তারা কি পারছে মানুষের মনে নিজেদের ভারত বিষয়ক নীতি ও জটিলতার বিষয়টি খোলসা করতে? অনেক ফ্রন্টে একসঙ্গে লড়াই জারি রাখা যায়; কিন্তু তা অচিরেই ক্লান্ত করে ফেলে। দেশের পাশাপাশি বাইরের বাংলাদেশীদের ধারণা আওয়ামী লীগের আমল মানে একতরফা শাসন। তারা কারও কথা শোনে না। কাউকে সম্মান করে না। বিষয়টা ঠিক না হলেও অনেক নেতার দাম্ভিকতা আর অহঙ্কার তাদের চেহারাতেই স্পষ্ট। পরিচিত ভোটারদের অনেকেই অভিযোগ করেন তারা গদিতে গেলে ব্যবহার পাল্টে ফেলেন। নিজেদের লোকদের কষ্ট ও দুঃখের কথা বুঝতে চান না। এর ভেতরেই আরেকটি ভয়াবহ মেজরিটি নীরবে তার চাল চালতে থাকে। এই সাইলেন্ট মেজরিটিকে আমি ভয় পাই। এরা রাজাকারদের ফাঁসির আওয়াজ তোলে আবার তাদের জানাজায় শরিক হয়। এরা গোলাম আযমকে ভালবাসে, জামায়াতকে চায় না। এরা নৌকা মার্কাকে ব্যাকডেটেড মনে করে, কিন্তু সে আমলে পুরস্কৃত হয়। এরা উন্নয়নের ফল খায়, উন্নয়নের মাঠে কোন কাজে শরিক হয় না। নিজের জীবন, আচরণ ও ব্যবহারে আধুনিক হলেও এরা চায় আমজনতা থাকুক মধ্যযুগে। এদের ভোটই কিন্তু বেশি। এখন এরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ট্রাম্পের মতো নেতার আবির্ভাবে আরও বেশি বিব্রত। কাজেই লীগের সামনে কঠিন সময়। এই সাইলেন্ট মেজরিটির আশায় দিনগোনা বিএনপি-জামায়াতকে পরাস্ত করতে হলে মাঠের রাজনীতি আদর্শের রাজনীতি নিয়ে সজাগ ও সতর্কভাবে এগোতে হবে। আদর্শের দিকটা প্রায় ঝাপসা। সেটাকে ঠিক করে বঙ্গবন্ধুর দলের মতো আচরণ করতে হবে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন বা তাঁর হাত শক্তিশালী করার মানুষরা নীরব থাকলে আমাদের ভবিষ্যত সাইলেন্ট মেজরিটির কাছেই জিম্মি হয়ে থাকবে। ভয়াবহ সাইলেন্ট মেজরিটিকে ভাইরেন্ট করার সময় এখন। এর কোন বিকল্প নেই।
×