ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণকালের কঠোর নিরাপত্তা একুশে গ্রন্থমেলায়

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

স্মরণকালের কঠোর নিরাপত্তা একুশে  গ্রন্থমেলায়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ স্মরণকালের সবচেয়ে কঠোর নিরাপত্তা আর মনিটরিংয়ের মধ্যে চলছে অমর একুশে বইমেলা। কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই সন্দেহজনক ঘোরাফেরার সময় শুক্রবার ১১ জনকে বইমেলা থেকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়াও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও রয়েছে। তাদের জঙ্গী নির্মূলে গঠিত পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কয়েকজনকে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তারা কোন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য কিনা, সে বিষয়ে তথ্য মেলেনি। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদেও তাদের কাছ থেকে সন্দেহজনক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে। জানা গেছে, এবার বইমেলার প্রতিটি প্রবেশ পথে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টরের পাশাপাশি নানা ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বইমেলায় আপত্তিকর বই বিক্রি হচ্ছে কিনা, সে বিষয়টিও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। নিয়মিত বিভিন্ন স্টলের ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে। কোন প্রকাশনা পরিকল্পিতভাবে অন্য কোন প্রকাশনার নামে আপত্তিকর বই প্রকাশ করছে কিনা, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করা হচ্ছে। এমনকি মেলায় যাতায়াতকারীদের গতিবিধি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মনিটরিং করার সময় শুক্রবার রাতে মেলা প্রাঙ্গণে ১১ যুবকের যাতায়াত সন্দেহজনক মনে হয়। তারা বিভিন্ন স্টলে যাতায়াত করছিল। তারা বইপত্র নাড়াচাড়া করে দেখছিল। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হয়। পরে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়। একপর্যায়ে রাতে তাদের আটক করা হয়। আটকের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্য বিভ্রান্তিমূলক মনে হচ্ছিল। এ ব্যাপারে রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, সন্দেহভাজন ১১ জন বিভিন্ন জায়গা থেকে বইমেলায় একত্র হয়েছিল। এদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও মাদ্রাসার ছাত্র রয়েছে। তাদের একত্র হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোন সদুত্তর মেলেনি। তারা কোন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য কিনা, বা তারা কোন খারাপ উদ্দেশ্যে মেলায় একত্র হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ জন্য তাদের পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে সন্দেহজনক কোন তথ্য মেলেনি। তাদের মোবাইল ফোনগুলো জব্দ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাতেও তেমন কোন সন্দেহভাজন কিছুর অস্তিত্ব মেলেনি। তারা কি কারণে মেলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্র হয়েছিল, সে বিষয়ে এখনও কোন সুস্পষ্ট তথ্য মেলেনি। তাদের দাবি, পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে তারা মেলায় একত্র হয়েছিল। ইতোমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কয়েকজনকে তাদের পিতামাতার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যাদের হস্তান্তর করা হয়েছে, তাদের যাবতীয় তথ্য রাখা হয়েছে। আর কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের পরিবারকে সংবাদ পাঠানো হয়েছে। তাদেরও পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে জঙ্গীবাদ বা আপত্তিকর কোন বিষয় সম্পর্কিত কোন তথ্য মেলেনি। তারপরও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মেলায় নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ২০১৫ সালে বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক অভিজিৎ রায় ও তার লেখা বই প্রকাশ করায় প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনকে হত্যা করে জঙ্গীরা। আর অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় তিনজনকে জঙ্গীরা হত্যাচেষ্টা করে। এরপর থেকেই বইমেলা ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর বইমেলা ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে চলছে নানামুখী তৎপরতা। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এবারের বইমেলায় অন্যান্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। মেলা প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে শত শত সিসি ক্যামেরা। একাধিক সংস্থার তরফ থেকে মনিটরিং চলছে। বসানো হয়েছে একাধিক কন্ট্রোল রুম এবং ওয়াচ টাওয়ার। দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশি শেষে মেলায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। প্রবেশ পথে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। তবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা মেলায় যাতায়াতকারীদের কোন বাড়তি ঝামেলার সৃষ্টি করছে না। মেলাকে আরও সুশৃঙ্খল করেছে। বাড়তি নিরাপত্তা মেলায় কোন প্রকার নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত মেলা চলছে। আর ছুটির দিনগুলোতে মেলা চলছে বেলা ১১টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত মেলাকে ঘিরে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নজরদারি করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী লেখক ড. অভিজিৎ রায় স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাসহ বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে জঙ্গী হামলার শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে অভিজিৎ রায়কে হত্যা এবং স্ত্রীকে আহত করে জঙ্গীরা। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয়তলায় ১৩১ নম্বর জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে (৪০) ঘাড় ও গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গীরা। একই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল (৫০), লেখক এবং ব্লগার প্রকৌশলী তারেক রহিম (৪২) ও রন দীপম বসুকে (৪০) হত্যাচেষ্টা করে জঙ্গীরা। এসব ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজন জঙ্গী গ্রেফতার হয়। এর মধ্যে আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সূত্র বলছে, বিতর্কিত বই লেখার কারণে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে। আর অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করায় জাগৃতি প্রকাশনার প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হয়। আর অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করার কারণে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে তিনজনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে অপারেশন সফল হয়নি। প্রসঙ্গত, জাগৃতি প্রকাশনা থেকে অভিজিৎ রায়ের লেখা বিশ্বাসের ভাইরাস ও অবিশ্বাসের দর্শন নামের ২টি বই প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশ করায় দীপনকে হত্যা করে জঙ্গীরা। আর শুদ্ধস্বর প্রকাশনা থেকে অভিজিৎ রায়ের লেখা ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ ও ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়। এই বই দুটি প্রকাশ করায় প্রকাশসহ অপর দুইজনকে হত্যা করতে হামলা চালিয়েছিল জঙ্গীরা। বই প্রকাশের সূত্র ধরে ঘটনাগুলো ঘটার কারণে এবার বইমেলায় নজিরবিহীন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
×