ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে এলে শিখা মাদার তেরেসা ভবনে যেতে চান ক্ষণিকের জন্য ॥ একাত্তরের যুদ্ধশিশু ২

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দেশে এলে শিখা মাদার তেরেসা ভবনে যেতে চান ক্ষণিকের জন্য ॥ একাত্তরের যুদ্ধশিশু ২

রাজন ভট্টাচার্য ॥ শিখা। জন্ম সাত মাসেই, অপরিণত অবস্থায় শিশু ভবনে সংরক্ষিত নথিপত্রে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ তার জন্মতারিখ উল্লেখ রয়েছে। জন্মের সময় শিশুটির ওজন হয়েছিল দুই কেজি ৭০০ গ্রাম। তবে শিশুটির জন্ম কোথায় হয়েছিল তা জানা যায়নি। জন্মের পর পুরনো ঢাকার মাদার তেরেসা শিশু ভবনে যিনি নিয়ে আসেন তার পরিচয়ও অজ্ঞাত। অর্থাৎ নথিপত্রেও তার পরিচয় নেই। শিশুটিকে অনাথ আশ্রমে দত্তক দেয়ার জন্য রেখে যাওয়া হয়েছিল। এরপর সিস্টার মার্গারেট মেরি পরিচয়হীন শিশুটির নাম দেন ‘শিখা’। আশ্রমে আনার পর থেকেই মেরি শিশুটির যতœ নেয়া শুরু করেন। ভগ্নস্বাস্থ্যের অপূর্ণাঙ্গ শিশুটি ছিল একেবারেই রোগা। তাই আশ্রম কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিল হয়ত শিশুটি বাঁচবে না। কানাডা থেকে ক্যাপুচিনোরা ঢাকায় এলেন বাংলাদেশ প্রকল্পের কাজে। তখন কানাডীয় দল শিখাকে সেখানে নেয়ার জন্য নির্বাচন করে। ক্যাপুচিনো দম্পতিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, শিখার মতো ক্ষীণ স্বাস্থ্যের মেয়েকে তারা কেন পছন্দ করছে তখন জবাবে তারা বলেন, ‘ও শিশু সদনের সবচেয়ে সুন্দর শিশু। ওর মুখচ্ছবি অতি মনোমুগ্ধকর। ওর ছোট ছোট হাত-পায়ের ওপরের দিকটা তামাটে, নিচের অংশ ফর্সা’। দত্তক নিতে আসা দম্পতির বক্তব্য হলো, তাদের জন্য ওটা ছিল শিশু মেয়েটিকে এক নজর দেখেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো বিষয়। দুর্বল স্বাস্থ্যের মেয়েটিবে বেছে নেয়ার পর ক্যাপুচিনোদের পরবর্তী চিন্তা ছিল দীর্ঘ যাত্রা শেষে ওই শিশুটিকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরা। শিশুটির পালক বাবা বনির এখনও স্পষ্ট মনে আছে, তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে খুব দুশ্চিন্তা পোহাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি ফেরা গেল। আস্তে আস্তে শিখা ভাল হতে থাকে। সুস্থ সবল শিশুর মতো বেড়ে ওঠে সে। সুন্দর ঝকঝকে মেয়ে হিসেবে প্রস্ফুটিত হয়। নতুন নাম দীপা মার্গারেট ॥ সময়ের কারণে ভাগ্য বদলে যেতে শুরু করে শিখার। বাংলাদেশ থেকে কানাডা যাওয়ার পর মন্ট্রিয়লে দত্তকের আনুষ্ঠানিকতা হয়। তখন ক্যাপুচিনোরা শিখার নাম দেন ‘শিখা দীপা মার্গারেট ক্যাপুচিনো’। বাবা-মা অবশ্য শিশু ভবনে সন্ন্যাসিনীদের দেয়া নাম ‘শিখা’ খুবই পছন্দ হয়েছিল বলেই সেটা রেখেই পুরো নামকরণ করা হয়েছিল। শিশু সদন থেকে দত্তক নেয়া দম্পতিকে বলা হয়েছিল, বাংলা ভাষায় শিখা অর্থ আগুনের দপ দর্শনীয় রূপ, যার সঙ্গে ক্যাপুচিনোরা যোগ করেন দীপা। শিখার শিক্ষাজীবন ॥ গড়পড়তা কানাডীয় প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণীর মতো শিখাও তার হাইস্কুল ডিপ্লোমার জন্য লেখাপড়া শেষ করেননি। ম্যাক্সভিল এলিমেন্টারি স্কুল থেকে পড়া শেষ করে শিখা গ্লোনগ্যারি জেলা স্কুলে পড়তে যায়। কিন্তু সে পড়াশোনা শেষ না করেই স্কুল ছেড়ে দেয়। এর পরপরই সে বুঝতে শেখে জীবনে সামনে এগিযে যেতে হলে হাইস্কুলের গ-ি পেরুতে হবে। একপর্যায়ে সে প্রাপ্তবয়স্কদের কোর্স নিতে শুরু করে, যাতে সে হাইস্কুলের ডিগ্রী নিতে পারে। এরপর শুরু হয় তার কর্মজীবনের যাত্রা। একের পর এক চাকরি বদলে শিখা তার চেনাজানা পরিধির ব্যাপ্তি ঘটায়। অতীত নিয়ে আগ্রহ নেই ॥ লেখকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শিখা জানান, তিনি এমন একটি বাড়িতে বড় হয়েছেন যেখানে কোন উষ্ণতা এবং পারিবারিক ভালবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আদরের কোন ঘাটতি ছিল না। পরিবারে একে অপরকে মূল্যায়ন করত স্নেহ, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। তিনি বড় হতে হতে বুঝতে শেখেন ওই বোধ কাজে প্রয়োগ করে লাভবান হতে পারে। শিখা জানান, তার মা-বাবা তাদের প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে একটি সত্যিকারের পরিচিতি দিয়েছেন তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য। বাবা বনি বলেন, শিখাকে সকলেই জানত। কারণ, সে ছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল সামাজিক, বন্ধুসুলভ এবং জনপ্রিয়। শিখার এখনও মনে পড়ে, তার এলিমেন্টারি শিক্ষক ক্লেয়ার বেজনেরকে, যিনি শিখাকে বর্ণনা করেছিলেন, ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী মেয়ে বলে। তার অতীদের দিকে নজর দিতে বাবা-মা নানা সময়ে উৎসাহ যুগিয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন নজর ছিল না শিখার। তিনি তার জন্ম ও দত্তক নেয়ার ইতিহাস শোনার পর কোন অস্বস্তিবোধ করেননি। অথবা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জন্য কোন অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভূতি তার হয়েছিল কখনও এ রকম ঘটনা শিখার মনে পড়ে না। তিনি জানেন, যুদ্ধশিশুদের কেউ কেউ ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিল। পরবর্তী সালে ’৯০ দশকে আবারও যায়। শিখা নিঃসঙ্কোচে বলেন, সে কখনও মনের মধ্যে কোন তাগিদ অনুভব করেনি যে তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে আরও কিছু জানা উচিত। যাতে সে নিজেকে বিশদভাবে জানতে পারবে এবং অন্যদেরও জানাতে পারবে। দেশে এলে শিখা যাবেন মাদার তেরেসা শিশু ভবনে ॥ শিখার মা বলেন, সে বড় হওয়ার পর মনে হয়েছে একেবারে সন্তুষ্টচিত্তে দিনরাত কাটাচ্ছে। শিখার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, জন্মদেশ বাংলাদেশের প্রতি তার একেবারেই আগ্রহ নেই বিষয়টি এমন নয়। দেশটির ব্যাপারে অনেকবার অনেক কিছুই বলতে চেয়েছে। তার বক্তব্য হলো ঠিক এ রকম, তিনি যদি কখনও বাংলাদেশে যান তাহলে মাদার তেরেসা শিশু ভবনে কিছু সময় কাটাবেন। কারণ, সেখান থেকেই তিনি কানাডায় এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশকে তার বাড়ি বলতে প্রস্তুত নন শিখা। তার ভাষ্য কানাডাই তার ঠিকানা। কারণ, ক্যাপুচিনো দম্পতির স্নেহ-আদরে কানাডার মাটিতেই তার বেড়ে ওঠা। শিখার ব্যক্তি জীবন ॥ বর্তমানে শিখা তার বাবা-মায়ের অফিস চাইল্ড হেভেন ইন্টারন্যাশনালে কাজ করছেন। সেখানে তিনি বিশেষ করে গণযোগাযোগ ও প্রশাসনিক কাজে বাবা-মাকে সহায়তা করছেন। তাছাড়া অন্যান্য তহবিল যোগানোর কাজে ও নতুন প্রকল্পের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে শিখার। তার ছেলেবন্ধু মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে তিনি একা হয়ে পড়েন। এরপর তিনি বাবা-মা ও ভাইবোনদের কাছে ফিরে যান। তারপর শিখা আবারও বিয়ে করেন। স্বামীর সঙ্গে ঘর করেন কয়েক বছর। কিন্তু সে বিয়েও বেশি দিন টেকেনি। দ্বিতীয় মেয়ে হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। তার ২০ বছরের মেয়ে ক্যাটরিনা ও ১০ বছরের মেয়ে কারমাকে নিয়ে ব্যস্ত জীবন পার করছেন শিখা। কারমা ড়্রইেড-৬ এ পড়াশোনা করছে। ক্যাটরিনা কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী শেষ করে মাস্টার্স করার পরিকল্পনা করছে। শিখা বলেন, জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট বিগত বছরগুলোতে মসৃণ হয়ে গেছে। তার বর্তমান যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশের কথা কল্পনা করার কোন অবকাশ নেই। অটোয়ায় বাংলাদেশ মুসলিম কমিউনিটি আয়োজিত ২০১২ সালের ইফতার মাহফিলে দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন শিখা। সেখানে তার বাবা ফ্রেড ছিলেন প্রধান বক্তা। ক্যাটরিনা ও কারমা দুজনেই শিখার মতো ওই সমাবেশটি উপভোগ করেন। শিখা বলেন, তিনি আগামী দিনেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগ্রহী। ক্যাপুচিনো পরিবারের গল্প ॥ কানাডায় সবচেয়ে নামী পরিবারগুলোর একটি হলো ‘ক্যাপুচিনো’ পরিবার। অন্য শিশুদের মতোই ‘শিখা’র আশ্রয় হয়েছিল এই পরিবারে। প্রবাদ আছে, এ পরিবারটি এমনই যে বিশ্বের সব অনাথদের তাদের বাড়িতে জায়গা করে দিতে পারলে তারা খুশিমনে তাই করতেন। তাদের বিয়ের আগে নিজেরাই ঠিক করেছিলেন দুটি শিশুর বেশি নিজেরা নেবেন না। একটি বা দুটি শিশু দত্তক নেয়ার পরিকল্পনাও ছিল তাদের। ফ্রেড ক্যাপুচিনো শিকাগোতে মেথডিস্ট মিনিস্টারের কাজ করতেন। স্ত্রী বনি নার্সিংয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ১৯৫৩ তাদের তাদের বিয়ে হয়। ১৯৫৪ সালে তাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পর বনি ১০৩ দত্তক সংস্থাকে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, তারা এমন একটি শিশু দত্তক নিতে ইচ্ছুক যাকে কোন কারণে দত্তক নিতে অসুবিধা হচ্ছে। জাতি গোষ্ঠীর মিশেলের কারণে অথবা বিকলাঙ্গ হওয়ার কারণে, যদিও তারা মহার্ঘ্য চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা বইতে অপারগ ছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস গ্রন্থটি লিখতে গিয়ে লেখক মুস্তফা চৌধুরী সাক্ষাত করেছেন ফ্রেড ও বনি দম্পতির সঙ্গে। তখন তারা লেখককে জানান, ১০৩ সংস্থার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সাড়া দিয়েছিল। জবাব আসা সব চিঠির সারমর্ম ছিল ঠিক এ রকম, ‘যেসব দম্পতির প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তান লাভের সুযোগ রয়েছে, আমরা তাদের দত্তকের জন্য কোন শিশুকে দিই না। পরে ফ্রেড ও বনি প্রথমে জাপান থেকে পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়েকে দত্তক নেন। এর মধ্যে এই দম্পতি বিভিন্ন দেশ থেকে সন্তান দত্তক নেয়। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশু শিখাকে ক্যাপুচিনো পরিবারে আনা হয়। এই দম্পতি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে। তাই অধিক সন্তান জন্ম দেয়া যাবে না। সব মিলিয়ে শিখা ছিল এই পরিবারের দশম সন্তান। এভাবে ১৯৫৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ক্যাপুচিনোরা তাদের পরিবারকে ২১ শিশুর পরিবারে উন্নীত করেন। এসব শিশুর মধ্যে ১৯টি এসেছিল বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। ভারতীয়, জাপানি, পাকিস্তানী, কম্বোডিয়ান, কোরিয়ান ও বাংলাদেশী শিশুও ছিল তাদের মধ্যে। এসব শিশুই যুদ্ধের শিকার। কৈফিয়ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাক বাহিনী কর্তৃক নিগৃহীত বঙ্গনারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হয় মুক্তিযুুদ্ধের পর। একাত্তরের যুদ্ধশিশু-১ এ অনবধানবশত মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত হয়ে যাওয়ায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
×