ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

সুনির্বাচিত প্রকাশনা বাংলা একাডেমির, বিপুল আগ্রহ

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সুনির্বাচিত প্রকাশনা বাংলা একাডেমির, বিপুল আগ্রহ

এক শিশু উপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। চোখে তার কৌতূহল। একটু অনুসরণ করতেই দেখা গেল, মাথায় টুকরি নিয়ে স্টলের এক কর্মী মেলায় প্রবেশ করছেন। টুকরির ভেতর থেকে নতুন বই উঁকি দিচ্ছে। শিশুটির কাছে অদ্ভুত দৃশ্য। দেখার চেষ্টা করছিল সে। তবে শুধু টুকরি করে নয়, ভ্যানে করেও বই ঢুকছিল মেলায়। প্রতিদিন ঢুকে। এত এত বই থেকে পছন্দের বইটি খুঁজে নেয়া কঠিন কর্ম। হিমশিম খেতে হয় পাঠককে। তবে এ কাজ সত্যি খুব সহজ হয়ে যায় বাংলা একাডেমির স্টলে গেলে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান থেকে সুনির্বাচিত বই প্রকাশ করা হয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলার একাদশতম দিন একাডেমির বই খুঁজে কাটল। গ্রন্থমেলায় একাডেমির দুটি প্যাভিলিয়ন। ৬টি বিক্রয় কেন্দ্র। একাডেমি চত্বরে একটি প্যাভিলিয়নসহ ৫টি বিক্রয় কেন্দ্র। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আছে একটি প্যাভিলিয়ন। সবকটি ঘুরে দেখা গেল সিরিয়াস গ্রন্থের সংখ্যা বেশি। খুশি হওয়ার মতো ব্যাপার এই যে, বিক্রিও বেশি। আগ্রহীদের জন্য বলা, একাডেমির প্রায় ৬ হাজার প্রকাশনা। এখন পাওয়া যাচ্ছে ১৪শ’ বই। আর মেলায় নতুন এসেছে ৬৬টি। পুরাতন ৩৫টি গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। নতুন ও পুনর্মুদ্রণ মিলিয়ে ১০১টি বই বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। আর অভিধানের কথা তো বলাই বাহুল্য। সব সময়ই বিক্রি হয়। এবার অবশ্য কৌশল গ্রহণ করেছে একাডেমি। অভিধানের যোগান কমিয়ে দিয়েছে। সিরিয়াস বইয়ের প্রতি আগ্রহ বুঝতেই এমন সিদ্ধান্ত। এবং এ নীরিক্ষাও সফল। অন্য সব মেলার চেয়ে এবার বেশি বিক্রি হচ্ছে সিরিয়াস বই। গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য ড. জালাল আহমেদ জানান, শুক্রবার পর্যন্ত মেলার প্রথম ১০ দিনে বাংলা একাডেমি ৩৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। গত বছর মেলায় ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। এর আগের বছর ২০১৫ সালে বিক্রি হয় ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বই। এ বছর প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকার বই বিক্রি হবে বলে আশা করছে একাডেমি। বাংলা একাডেমি থেকে আসা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে এস ওয়াজেদ আলীর ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’, হুমায়ূন কবিরের ‘নদী ও নারী’, শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি: ফোকলোর সংগ্রহশালা’, ‘অভিবাদন : শহীদ কাদরী, ‘পরানের গহিন ভিতরে’, আবুল হাসনাত সম্পাদিত শামসুর রাহমান রচনাবলি (প্রথম খ-)। পুনর্মুদ্রিত বইগুলোর মধ্যে ভাল বিক্রি হচ্ছে হারুন-অর-রশিদের ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফার ৫০ বছর’, আবু সাইয়িদের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও কূটনৈতিক যুদ্ধ’, আব্দুল হামিদ সম্পাদিত ‘আইনকোষ’ এবং সম্পাদিত গ্রন্থ ‘প্রশাসনিক পরিভাষা।’ নির্বাচিত বই ॥ নির্বাচিত বইয়ের আলোচনায় আজ বাংলা একাডেমি থেকে আসা বইগুলোর কথাই বলা যাক। একাডেমি থেকে আসা খুব উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা ‘ওশান অব সরো।’ মীর মশাররফ হোসেনের কালজয়ী রচনা ‘বিষাদসিন্ধু’র অনুবাদ করেছেন ফখরুল আলম। বহুকাল আগে একাডেমি থেকে মীর মশাররফ হোসেনের সমগ্র প্রকাশ হয়েছিল। সেখান থেকে এই অনুবাদ গ্রন্থ। বইটির মূল্য ৯৫০ টাকা। একাডেমি ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। প্রতিটি জেলার ওপর আলাদা আলাদা বই প্রকাশ করেছে। এই সিরিজের বইগুলো সংগ্রহে রাখার মতো। মেলার আগে থেকেই আলোচিত ‘মূলধারার রাজনীতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬।’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের লেখক হারুন-অর-রশিদ। আওয়ামী লীগের ২০টি নিয়মিত কাউন্সিল, ২টি বিশেষ কাউন্সিল এবং ২০টি পরিশিষ্ট অনুসরণ করে এই গবেষণাধর্মী রচনা। দলের নেতৃত্ব নির্বাচন, নীতি নির্ধারণ, ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র, কর্মসূচীতে বিভিন্ন সময়ে যেসব পরিবর্তন পরিমার্জন ও সংযোজনের ঘটনা ঘটেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বাঙালীর রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতির মূল ধারা হিসেবে উল্লেখ করেন লেখক। একাডেমি সূত্রে জানা যায়, এরই মাঝে বইয়ের প্রথম সংস্করণ শেষ হয়েছে। আসছে নতুন সংস্করণ। বইটির মূল্য ৪০০ টাকা। তপন পালিতের ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার আন্দোলন ১৯৭১-২০১৩’ বইটির কথাও উল্লেখ করার মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে দীর্ঘ আন্দোলন তার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস বইতে পাওয়া যাবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দাবির গোড়ার কথা, গণআদালতের প্রেক্ষাপট, গণআদালত পরবর্তী আন্দোলন এবং সর্বশেষ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত ওঠে এসেছে বইতে। মূল্য ৫০০ টাকা। একাডেমির করা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত শওকত ওসমান জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থটিও বেশ সমৃদ্ধ। বিশিষ্টজনেরা মহান কথাসাহিত্যিককে নিয়ে লিখেছেন। একটি বই থেকেই অনেকখানি পাওয়া হয়ে যায় শওকত ওসমানকে। একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক ধ্রুপদী গ্রন্থ। মেলায় এসেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপন্যাস ‘শকুন্তলা’। প্রাচীন সাহিত্যের অনন্য উপাদান এই গ্রন্থ। পৌরাণিক প্রেম কাহিনী এখনও দারুণ মুগ্ধ হয়ে পাঠ করছেন পাঠক। বইটি তাই প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। মূল্য ১৩০ টাকা। আগ্রহ নিয়ে পাঠক সংগ্রহ করছেন কাজী ইমদাদুল হকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আবদুল্লাহ।’ অদ্বৈতমল্লবর্মণের অমর সৃষ্টি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। শিশু-কিশোরদের জন্য বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম জালাল ফিরোজের ‘ছোটদের পার্লামেন্ট।’ একই বিষয়ে এর আগে বড়দের জন্য লিখেছেন তিনি। এবার লিখেছেন ছোটদের উপযোগী করে। জাতীয় সংসদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য বইতে অনেকটা গল্পের ছলেই বলেছেন লেখক। সহজ লেখা ও ছবি ছোটদের সহজেই আকর্ষণ করবে। মেলায় একাধিক মন্ত্রী ॥ গতকাল বিকেলে মেলা পরিদর্শনে আসেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মেলা ঘুরে তিনি বলেন, আমরা সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ মেলায় বজায় রাখতে চাই। পাঠকরা যাতে এসে নির্বিঘেœ মেলায় ঘুরতে পারে, বই সংগ্রহ করতে পারে, ক্লান্ত হলে একটু বসে বিশ্রাম নিতে পারে এই দিকগুলো নিশ্চিত করেছি। সন্ধ্যায় মেলায় আসেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি মেলা ঘুরে দেখেন। এবারের মেলায় চারুলিপি প্রকাশন থেকে প্রকাশ হয়েছে তার লেখা গ্রন্থ ‘রুখে দাঁড়াবার সময়’। মেলায় আরও এসেছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২০১ নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা যায়, গতকাল মেলার ১১তম দিনে নতুন বই এসেছে ২০১টি। এগুলোর মধ্যে গল্প ২৫, উপন্যাস ৩৩, প্রবন্ধ ১৩, কবিতা ৫৬, গবেষণা ৪, ছড়া ৫, শিশুসাহিত্য ৮, জীবনী ১, মুক্তিযুদ্ধ ৬, নাটক ২, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ৭, ইতিহাস ৫, রাজনীতি ১, কম্পিউটার ১, ধর্মীয় ১, অনুবাদ ৪, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর আরও ২৫টি এসেছে। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে এদিন ৬২টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইগুলোর মধ্যে ছিল উৎস প্রকাশনী থেকে আসা সাহাদাত পারভেজের ‘গজারিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।’ মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে এদিন ছিল ‘আবদুল গফুর হালী : জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাসির উদ্দিন হায়দার। আলোচনা করেন রাহমান নাসির উদ্দিন এবং সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন শামসুল হোসাইন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী কল্যাণী ঘোষ, কান্তা নন্দী, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস এবং সাজেদুল ইসলাম ফাতেমী।
×