ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞ কমিটি রিপোর্ট দিয়েই খালাস, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিশেষজ্ঞ কমিটি রিপোর্ট দিয়েই খালাস, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না

নিখিল মানখিন ॥ সাত বছর ধরেই চলছে ওষুধশিল্প নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির ওষুধ কোম্পানি পরিদর্শন এবং প্রতিবেদন তৈরির কাজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে একবার প্রতিবেদন প্রকাশ এবং অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোকে সতর্ক ও কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়ার মধ্যেই যেন সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুপারিশ দেয়ার মধ্যেই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। সুপারিশ কার্যকরের মূল দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে গত বছর ২০টি ওষুধ কোম্পানির নিবন্ধন বাতিলসহ মোট ৫৬টি ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করে বিশেষজ্ঞ কমিটি। সুপারিশ অনুযায়ী ২০টি ওষুধ কোম্পানির নিবন্ধন বাতিলের আদেশ কার্যকর এবং বাকি ৩৬টি কোম্পানির ওপর আরোপকৃত বিধিনিষেধ কার্যকর করার বিষয়টি নিয়েও জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭ বছর ধরে পরিদর্শন চলছে। এভাবে গত বছর মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০টি ওষুধ কোম্পানির নিবন্ধন বাতিলসহ মোট ৫৬টি ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করে ওষুধশিল্প নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভায় বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ১৪টি কোম্পানি এ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন করতে পারবে না এবং ২২টি কোম্পানি শুধু নন-পেনিসিলিন এ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে পারবে এমন সুপারিশ করে কমিটি। এছাড়া অনুমোদনহীন বা নকল ওষুধ যেসব প্রতিষ্ঠানে (ওষুধের দোকান বা হাসপাতাল) পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ওষুধশিল্পের পরিস্থিতি জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এই কমিটির সদস্য। বিশেষজ্ঞ কমিটি মোট ২৪২টি ওষুধ কোম্পানি পরিদর্শন করেছে। ২০১১ সালে কমিটি প্রথম প্রতিবেদন দেয়। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেশকিছু কোম্পানিকে সতর্ক করা হয়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ২০১৩ সালে আরও একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়। এপর্যায়ে মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যর্থ এমন ৮৪টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়। সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে কমিটি গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সংসদীয় কমিটিকে রিপোর্ট দেয়। ওষুধ তৈরির কারখানা পরিদর্শনের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস) নীতিমালাকে মানদ- ধরা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ-ছয় বছরে কিছু কোম্পানি কারখানার সন্তোষজনক উন্নতি ঘটিয়েছে। কারও উন্নতি মাঝারি গোছের। অনেকে উন্নতি করার নামে শুধু সময়ক্ষেপণ করেছে। কারও কারও কারখানায় কোনো উন্নয়নই হয়নি, বরং আগের চেয়ে মানের অবনতি ঘটেছে। এদিকে, নিম্নমানের ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং ডক্টরস অব হেলথ এ- এনভায়রনমেন্ট এর বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ডা: রশিদ ই-মাহাবুব জনকণ্ঠকে জানান, দেশে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে মনিটরিং কার্যক্রম। পরীক্ষার আওতার বাইরে থাকা ওষুধগুলো অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল ও কার্য দক্ষতাও বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, যে কোন ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারেন। মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জনকণ্ঠকে জানান, ভেজাল রোধ করতে হলে নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। যে কোনভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। জেলা পর্যায়ে সম্ভব না হলেও বিভাগীয় পর্যায়ে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে হবে। শুধুমাত্র গড়ে তুললেই হবে না, জনবল ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে ল্যাবরেটরিগুলো গতিশীল করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে যথাযথ সরকারী সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোম্পানিগুলোকে সঠিকমানের ওষুধ বানাতে বাধ্য করতে হবে। শুধু তাই নয়, ওষুধ প্রশাসনের লোকজন যাতে প্রভাবিত না হতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিকে স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ল্যাব হবে পুরোপুরিভাবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে সকল ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশে এখনও ভালো ওষুধ কোম্পানির সংখ্যাই বেশি। তবে কিছু কিছু দেশীয় কোম্পানি মানহীন ওষুধ তৈরি করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এদিকে, মানবহির্ভূত ওষুধ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিদফতর থেকে অধিদফতরে রূপ নেয়ার এক বছর পরও গতিশীল হতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড ছাড়া কোন কিছুতে পরিবর্তন আসেনি। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অভিযান সহায়ক যানবাহনের অবস্থাও আগের মতোই রয়ে গেছে। কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েও তারা ভেজাল ওষুধবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে না। অধিদফতরের এমন দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। দেশে প্রায় ২০০ ওষুধ কোম্পানি নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত করছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের আবেদন করেই ওষুধ প্রস্তুত করে চলেছে।
×